[সম্প্রতি গাজায় ইসরাইলি আগ্রাসনের প্রেক্ষিতে ইসরাইল ও তাদের সহযোগিতাকারী কোম্পানীর পণ্য বয়কট বিষয়ক এটি একটি বিশদ ফতোয়ার সংকলন। যা ইসলামী অর্থনীতিতে উচ্চতর গবেষণামূলক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মারকাযু দিরাসাতিল ইকতিসাদিল ইসলামীর ফতোয়া বিভাগ থেকে প্রকাশ করা হয়েছে]
প্রশ্ন :
সম্প্রতি ফিলিস্তিনের মজলুম মুসলিম জনগোষ্ঠি জায়নবাদী ইসরাইল দ্বারা সীমাহীন জুলুমের শিকার হচ্ছে। নির্বিচারে নারী-শিশুকে হত্যা করা হচ্ছে। অগণিত মজলুম মানুষকে আহত এবং বাস্তুচ্যুত করছে অত্যাচারী জায়নিস্ট ইসরাইল।
অপরদিকে দেখা যাচ্ছে-আমাদের বাজারে পশ্চিমা দেশের তৈরি নানা পণ্য রয়েছে। যা থেকে অর্জিত লাভ/মুনাফার একটি অংশ সেসব রাষ্ট্র কর হিসাবে পেয়ে থাকে। সেই সামগ্রিক কর থেকে তারা সরাসরি ইসরাইলকে সহযোগিতা করে থাকে। এতে বিষয়টি অনেকটা এরকম হয়ে যাচ্ছে যে, আমাদের কাছে পণ্য বিক্রয় করে আমাদের অর্থ দিয়েই মুসলিম নিরপরাধ ভাই-বোন ও শিশু নিধনে কিছুটা হলেও সহযোগিতা হচ্ছে।
এ পরিস্থিতিতে, পশ্চিমা দেশের তৈরি কোনও পণ্য বা প্রোডাক্ট যা থেকে কোনও না কোনও ভাবে সন্ত্রাসী ইসরাইল রাষ্ট্র আর্থিক সহায়তা পেয়ে থাকে, তা আমাদের জন্য ক্রয় করার ব্যাপারে শরীয়াহ কী বলে?
দলীল-প্রমাণ ও তথ্যসহ উত্তর দিয়ে বাধিত করবেন। আল্লাহ পাক আপনাদেরকে এর উত্তম বিনিময় দান করুন।
নিবেদক
মুহাম্মাদ সানাউল্লাহ, বনশ্রী, ঢাকা।
بسم الله الرحمن الرحيم
حامدا ومصليا ومسلما
উত্তর :
মূল উত্তরের পূর্বে জালেমকে প্রতিহত করা ও মজলুমের পাশে দাঁড়ানোর ব্যাপারে ইসলামের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ উসূল ও নীতি উল্লেখ করা হল-
কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ উসূল ও নীতি
১। জুলুম সর্বাবস্থায় হারাম ও ঘৃণিত। সেই জুলুম এর শিকার মুসলিম বা অমুসলিম যেই হোক না কেন। কুরআনুল কারীমে জুলুমের ভয়ঙ্কর পরিণতি উল্লেখ করা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে-
وَلَا تَحْسَبَنَّ اللّهَ غَافِلًا عَمَّا يَعْمَلُ الظَّالِمُونَ ۚ إِنَّمَا يُؤَخِّرُهُمْ لِيَوْمٍ تَشْخَصُ فِيهِ الْأَبْصَارُ، مُهْطِعِينَ مُقْنِعِي رُءُوسِهِمْ لَا يَرْتَدُّ إِلَيْهِمْ طَرْفُهُمْ ۖ وَأَفْئِدَتُهُمْ هَوَاءٌ.
অর্থ : তুমি কিছুতেই মনে করো না জালেমগণ যা কিছু করছে আল্লাহ সে সম্পর্কে বেখবর। তিনি তো তাদেরকে সেই দিন পর্যন্ত অবকাশ দিচ্ছেন, যে দিন চক্ষুসমূহ থাকবে বিস্ফারিত। তারা মাথা তুলে দৌড়াতে থাকবে। তাদের দৃষ্টি পলক ফেলার জন্য ফিরে আসবে না। আর (ভীতি বিহ্বলতার কারণে) তাদের প্রাণ উড়ে যাওয়ার উপক্রম হবে। (সূরা ইবরাহীম, আয়াত নং ৪২-৪৩)
অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে- أَسْمِعْ بِهِمْ وَأَبْصِرْ يَوْمَ يَأْتُونَنَا ۖ لَٰكِنِ ٱلظَّٰلِمُونَ ٱلْيَوْمَ فِى ضَلَٰلٍۢ مُّبِينٍۢ
অর্থ : যে দিন তারা আমার কাছে আসবে সে দিন তারা কতইনা শুনবে এবং কতইনা দেখবে! কিন্তু জালেমগণ আজ স্পষ্ট গোমরাহীতে নিপতিত। (সূরা মারইয়াম, আয়াত নং ৩৮)
হাদীসেও এ বিষয়ে ভয়াবহ পরিণতির কথা বলা হয়েছে। হযরত ইবনে উমর রা. থেকে বর্ণিত, নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন- اتقوا الظلم. فإن الظلم ظلمات يوم القيامة
অর্থ : তোমরা জুলুম থেকে বেঁচে থাক। কেননা, জুলুম কেয়ামতের দিন ভীষণ অন্ধকার (ভয়াবহ শাস্তি) হয়ে দেখা দিবে। (সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ২৫৭৮)
সুতরাং জুলুম ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সর্বাবস্থায় হারাম, নিষিদ্ধ ও ঘৃণিত।
২। জুলুম যেখানেই হবে, সেখানে সাধ্যানুসারে এর বিপক্ষে অবস্থান করা, মজলুমের পাশে দাঁড়ানো, জালেমের শক্তি খর্ব করতে ভূমিকা রাখা একজন মুসলিমের ঈমানের অন্যতম দাবি। হযরত আনাস রা. থেকে বর্ণিত, নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
انصر أخاك ظالما أو مظلوما فقال رجل: يا رسول الله، أنصره إذا كان مظلوما، أفرأيت إذا كان ظالما كيف أنصره؟ قال: تحجزه أو تمنعه من الظلم فإن ذلك نصره.
অর্থ : তুমি তোমার ভাইকে সাহায্য কর, চাই সে জালেম হোক বা মজলুম হোক। একজন সাহাবী প্রশ্ন করলেন, হে আল্লাহর রাসূল, মজলুম হলে তো সাহায্য করব কিন্তু জালেম হলে কিভাবে সাহায্য করব? নবীজী বললেন, তাকে তার জুলুম থেকে বাধা দিবে। এটাই তার সাহায্য করা। (সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৬৯৫২)
৩। জুলুমের প্রতিরোধ, জালেমের বিরুদ্ধে অবস্থান ও মজলুমের পাশে দাঁড়ানোর নানা পথ ও মাধ্যম রয়েছে। স্থান, ব্যক্তি ও সময় অনুসারে এসব পথ ও পদ্ধতিও ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে। কোনও পদ্ধতি হয়ে থাকে নিকটতম, কোনওটা দূরবর্তী। জালেমের শক্তি খর্ব করার প্রশ্নে দূরবর্তী হলেও যেকোনও পদক্ষেপ ও পদ্ধতিতে সাধ্যানুসারে অংশগ্রহণ করা প্রত্যেক মুসলিমের ঈমানের অন্যতম দাবি ও আলামত। বিশেষত যখন জুলুম হবে মুসলিমদের উপর।
৪। কখনও এমন হয়, জালেমকে তৃতীয় একটি পক্ষ সহযোগিতা করে যাচ্ছে। সেক্ষেত্রে অন্যদের উচিত, সেই তৃতীয় পক্ষকে সহযোগিতা করা হয়-এমন কাজ থেকেও যথাসম্ভব বিরত থাকা।
মোটকথা, জালেমের বিপক্ষে বিশেষত মুসলিমদের উপর জুলুমের বিপক্ষে দূরবর্তী কোনও মাধ্যমে হলেও সাধ্যানুসারে অংশগ্রহণ করা একজন মুসলিমের ঈমানের গায়রত ও আত্মমর্যাদার দাবি।
উপরোক্ত মৌলিক কথাগুলো আরযের পর এবার আপনার মূল উত্তর প্রদান করা হচ্ছে-
বর্তমান ফিলিস্তিনের মজলুম মুসলিম জনগোষ্ঠির বিরুদ্ধে জায়নবাদী ইসরাইল রাষ্ট্র যে জুলুম করে যাচ্ছে তা দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট। পশ্চিমা বিশ্বের নানা দেশ ইসরাইলকে মদদ দিয়ে যাচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে পূর্বোক্ত নীতিমালা অনুসারে বাংলাদেশের মুসলিমদের করণীয় হল-
বাংলাদেশের মুসলিমদের করণীয়
ক. “দলীল-প্রমাণ ও প্রয়োজনীয় বিশ্লেষণ” এর ধারা নং ১ এ বর্ণিত সরাসরি ইসরাইল রাষ্ট্রকে সহযোগিতাকারী কোনও কোম্পানির পণ্য বা সেবা ক্রয় করা থেকে যথাসম্ভব বিরত থাক
খ. পশ্চিমা দেশের যে সকল কোম্পানীর পণ্য/সেবার বিক্রিলব্ধ লাভের একটি অংশ সেসব রাষ্ট্র কর হিসাবে পেয়ে থাকে এবং সেই সামগ্রিক কর থেকে ইসরাইল রাষ্ট্রকে সহযোগিতা করে, এমন কোম্পানির পণ্যও যথাসম্ভব ক্রয় করা থেকে বিরত থাকা একজন মুসলিমের ঈমানের গায়রত ও আত্মমর্যাদার দাবি।
গ. যে সকল পণ্য/সেবা প্রাত্যহিক জীবনে অপরিহার্য, বিশেষত খাদ্যদ্রব্য, চিকিৎসা বা প্রযুক্তি এবং সেগুলোর কোন যথোপযুক্ত বিকল্প নেই, সেসব পণ্য প্রয়োজন পরিমাণ ক্রয় ও ব্যবহারের সাথে সাথে তার বিকল্প খোঁজা ও আবিস্কার করা মুসলমানদের ঈমানী দাবি।
ঘ. ব্যক্তিগত বর্জনের পাশাপাশি ব্যবসায়িকভাবেও সকল প্রকার (উপরোক্ত ক ও খ বর্ণিত উভয় প্রকার) পণ্য ও সার্ভিস বর্জন করা। মুদি দোকান, রেস্টুরেন্ট ও অন্যান্য ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানে এ ধরনের পণ্য না রাখা। যেমন পেপসি, কোক, নেসলের পণ্য ইত্যাদি। বরং এর বিকল্প পণ্য রাখা। শুধু তাই নয়; ‘এখানে ইসরাইল রাষ্ট্রকে সহযোগতিা করে এমন কোনও পণ্য রাখা হয় না’ মর্মে লিখিত নোটিশ টাঙ্গিয়ে দেয়া-ঈমানের আত্মমর্যাদার বড় পরিচয়। এতে মানুষ সহজেই এ ধরনের পণ্য ক্রয়ে অনাগ্রহী হবে ও এর বিকল্প গ্রহণে উৎসাহিত হবে।
ঙ. এ ধরনের কোনও পণ্যের ডিলার হয়ে থাকলে, বা ফ্র্যাঞ্চাইজি হয়ে থাকলে তা দ্রুত প্রত্যাহারের চেষ্টা করা এবং এর বিকল্প পণ্যের ডিলারশিপ বা ফ্র্যাঞ্চাইজিং গ্রহণের চেষ্টা করা।
চ. এ ধরনের (প্রথমোক্ত ক ও খ বর্ণিত উভয় প্রকার) কোম্পানিতে বিনিয়োগ বর্জন করা। শেয়ার বাজারে এমন কোন কোম্পানির স্টক কেনা থাকলে তা দ্রুত বিক্রি করে বের হয়ে আসা। এছাড়া অন্যান্য আর্থিক ও কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান যারা শেয়ার বাজারে বড় আকারে বিনিয়োগ করে থাকে, তাদের শেয়ার বাজারের বিনিয়োগগুলো ইসরাইলী কোম্পানিতে হলে বা ইসরাইলকে সহযোগিতা করে এমন কোন কোম্পানিতে হলে সে সকল কোম্পানির বিনিয়োগ প্রত্যাহার করে বেরিয়ে আসা।
ছ. ইসরাইলকে মদদ করে এমন পণ্য ও সেবা বর্জনকে দীর্ঘমেয়াদী ও কার্যকর করতে বিকল্প দেশীয় কোম্পানিতে বিনিয়োগ করা এবং অন্যকে বিনিয়োগে উৎসাহিত করা। এতে দেশের অর্থনীতি এবং মুদ্রাও শক্তিশালী হবে, এবং দীর্ঘমেয়াদে দেশের বাজারে পণ্যের মূল্য স্থিতিশীল হবে ইনশাআল্লাহ।
এক কথায়, এমন সকল কার্যক্রম যা ইসরাইলকে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিতে সহযোগিতা করে তা সর্বৈব বর্জন করা, এবং অন্যকে বর্জন করতে সহযোগিতা ও উৎসাহিত করা বর্তমান সময়ে প্রত্যেক মুসলমানের কর্তব্য এবং ঈমানের দাবি, যার প্রতি সকলকে সচেষ্ট হতে হবে।