ice_screenshot_20180306-211018

পাপ কাজে সহযোগিতার বিধান

ভূমিকা

পবিত্র কুরআনুল কারীমে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা ইরশাদ করেন, 

وَتَعَاوَنُوا عَلَى الْبِرِّ وَالتَّقْوَىٰ ۖ وَلَا تَعَاوَنُوا عَلَى الْإِثْمِ وَالْعُدْوَانِ

“তোমরা একে অপরকে নেক ও তাকওয়ার কাজে সহযোগিতা করো। অন্যায় ও পাপ কাজে সহযোগিতা করো না।” -সূরা মায়েদা : ০২

এটি কুরআনের একটি ব্যাপক অর্থবোধক আয়াত। যাতে সকল ধরনের পাপ কাজে সহায়তা করা থেকে নিষেধ করা হয়েছে। চাই তা ছোট হোক, কিংবা বড় হোক। ফুকাহায়ে কেরাম এই আয়াতকে সামনে রেখে হাজারো মাসআলা উদ্ঘাটন করেছেন। মুফাসসিরগণ এর ব্যাখ্যায় রচনা করেছেন তাফসীরের হাজার পৃষ্ঠা। যুগে যুগে মুসলিম স্কলারগণ এই আয়াতকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন গ্রন্থ ও গবেষণাকর্ম প্রকাশ করেছেন।  

উপমহাদেশের নিকট অতীতের অন্যতম ইসলামী স্কলার, পাকিস্তানের গ্রান্ড মুফতি, মুফতি শফী রহ. তার মূল্যবান কিতাব জাওয়াহিরুল ফিকহে এ বিষয়ে একটি গবেষণাধর্মী মূল্যবান প্রবন্ধ রচনা করেছেন। যার শিরোনাম হলো, ‘তাফসীলুল কালাম ফি মাসআলাতিল ইআনাতি আলাল হারাম’। যাতে তিনি পাপ কাজে সহযোগিতার নানার দিক নিয়ে ফিকহ ও হাদীসের গ্রন্থসমূহের সুবিস্তৃত আলোচনাকে Summarize করে অত্যন্ত সংক্ষিপ্তভাবে মূলনীতি আকারে পেশ করেছেন।  

মুফতি শফী রহ. এর সেই গবেষণা অবলম্বনে প্রস্তুত করা হয়েছে বক্ষমাণ প্রবন্ধটি। যুক্ত করা হয়েছে বেশ কিছু আধুনিক দৃষ্টান্ত। যা পাঠককে আরো বেশি উপকৃত করবে বলে আশা রাখি।   

পাপ কাজে সহযোগিতা

পাপ কাজে সহযোগিতা কী? এমন কিছু করা যা পাপির জন্য পাপ কাজকে সহজ করে দেয়। উদাহরণস্বরূপ সিগারেট খাওয়া একটি পাপ কাজ। আমি যদি সিগারেটে অভ্যস্ত কাউকে এক প্যাকেট সিগারেট কিনে দেই, তবে এটি তার পাপ কাজে সহযোগিতা হলো। 

পাপ কাজে সহযোগিতার বিভিন্ন স্তর হতে পারে। কোনটা সরাসরি সহযোগিতা, আবার কোনটা অনেক দূরবর্তী। যেমন ধুমপানকারী রিকশা চালকের রিকশায় চড়া। রিকশায় চড়লে তাকে ভাড়া দিতে হবে। সম্ভাবনা আছে, এই ভাড়া দিয়ে সে সিগারেট কিনে খাবে। এমতাবস্থায় রিকশায় চড়াটা পাপ কাজে সহযোগিতা হবে কিনা? উত্তর হলো, না। কারণ, পাপ কাজের সাথে এর সম্পর্ক অনেক দূরবর্তী। 

অতএব, কোন কাজটি পাপ কাজে সহযোগিতা, যাকে কুরআন নিষিদ্ধ করেছে, আর কোনটি সহযোগিতা না এটি নির্ণয়ের জন্য সুনির্দিষ্ট মানদণ্ড প্রয়োজন। নিম্নে তা সংক্ষিপ্তভাবে পেশ করা হলো।  

পাপ কাজে সহযোগিতার বিভিন্ন স্তর ও তার বিধান

পাপ কাজে সহযোগিতার বিভিন্ন স্তর আছে এবং স্তরভেদে বিধানের মাঝেও পার্থক্য রয়েছে। প্রথমত একে দুইটি স্তরে ভাগ করা যেতে পারে : 

প্রথম স্তর : নিজ ইচ্ছায় সরাসরি পাপ কাজে সহযোগিতা করা। নিজ ইচ্ছায় পাপ কাজে সহযোগিতার দুই অর্থ। 

১.  বাস্তবেই ইচ্ছা প্রকাশ পওয়া। 

২. বাস্তবে ইচ্ছা প্রকাশ করেনি, কিন্তু ‘হুকমি’ তথা বিধানগতভাবে তাতে পাপ কাজে সহযোগিতার ইচ্ছা আছে প্রমাণিত হওয়া।

১ম প্রকারের ব্যাখ্যা (বাস্তবেই স্ব ইচ্ছায় পাপ কাজে সহযোগি করা) : 

বাস্তবেই স্ব ইচ্ছায় পাপ কাজে সহযোগি করার অর্থ হলো, সহযোগিতামূলক কাজটি করার সময়ই মনের মাঝে পাপ কাজে সহযোগিতার ইচ্ছা লালন করা। কিংবা চুক্তির সময়ই কোন এক পক্ষ পাপ কাজের কথা স্পষ্টভাবে বলা। যেমন, কেউ বাড়ি বানাচ্ছে এই উদ্দেশ্যে যে এখানে একটি সুদী ব্যাংক প্রতিষ্ঠা হবে। এরপর বাড়ি তৈরি শেষে সেটা সুদী ব্যাংকের কাছে ভাড়া দিলো। অথবা বাড়ি করার সময় এমন নিয়ত ছিল না, কিন্তু যখন তৈরি শেষ হল, তখন কোন সুদী ব্যাংক এর পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হল যে, আমরা আপনার বাড়িটি ভাড়া নিয়ে আমাদের একটি ব্রাঞ্চ খুলতে চাই, সেও রাজি হয়ে ভাড়া দিলো। 

২য় প্রকারের ব্যাখ্যা (বাস্তবে ইচ্ছা প্রকাশ করেনি, কিন্তু ‘হুকমি’ তথা বিধানগতভাবে তাতে পাপ কাজে সহযোগিতার ইচ্ছা আছে প্রমাণিত হয়) : 

এর দৃষ্টান্ত হলো, এমন বস্তু তৈরি করা বা বিক্রি করা, যা কেবল পাপ কাজেই ব্যবহার করা যায়। ব্যক্তি এক্ষেত্রে পাপ কাজে সহযোগিতার সরাসরি ইচ্ছা প্রকাশ না করলেও সেখানে তার ইচ্ছা আছে বলে ধর্তব্য হবে। যেমন সিগারেট বিক্রি করা। ঢোল, তবলা বানানো। এমন সফটওয়্যার তৈরি করা, যা কেবল সুদী ব্যাংকেই ব্যবহার করা যায়। এমনিভাবে গেমিং সফটওয়্যার তৈরি করা ইত্যাদি।

বিধান : পাপ কাজে সহযোগিতার ইচ্ছা বাস্তবে থাকুক বা হুকমী তথা বিধানগতভাবে থাকুক, উভয় প্রকারই কুরআনে নিষিদ্ধ পাপ কাজে সহযোগিতার মাঝে অন্তর্ভুক্ত তথা হারাম। 

দ্বিতীয় স্তর : পাপ কাজের ‘সাবাব’ তথা কারণ বা মাধ্যম হওয়া। এটিও পাপ কাজে সহযোগিতার অংশ এবং কুরআনে বর্ণিত নিষেধাজ্ঞার অন্তর্ভুক্ত। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা ইরশাদ করেন, 

وَلَا تَسُبُّوا الَّذِينَ يَدْعُونَ مِن دُونِ اللَّهِ فَيَسُبُّوا اللَّهَ عَدْوًا بِغَيْرِ عِلْمٍ ۗ

“(হে মুসলিমগণ!) তারা আল্লাহর পরিবর্তে যাদের পূজা করে, তোমরা তাদেরকে গালি দিয়ো না। কেননা পরিণামে তারা অজ্ঞতাবশত সীমালঙ্ঘন করে আল্লাহকে গালি দিবে।” -সূরা আনআম : ১০৮

এর অনেক স্তর আছে। সব স্তর নিষেধাজ্ঞার অন্তর্ভুক্ত নয়। উদাহরণ স্বরূপ কেউ চাষাবাদ করছে, আর সেই শস্য পাপী লোকদের আহার যোগাচ্ছে। যে আহার ভক্ষণ করে তারা আল্লাহর নাফরমানি করবে। তো এই চাষাবাদও পাপ কাজটি সংগঠিত হওয়ার একটি মাধ্যম বা কারণ। কিন্তু এটি অনেক দূরবর্তী কারণ। এটি কুরআনে বর্ণিত পাপ কাজে সহযোগিতার নিষেধাজ্ঞার অন্তর্ভুক্ত নয়। 

পাপ কাজের সবাব তথা কারণ বা মাধ্যম হওয়ার বিষয়টি প্রাথমিকভাবে দুই প্রকার :

ক. দূরবর্তী সাবাব : এটি বৈধ।

খ. নিকটবর্তী সাবাব : এটি কুরআনে বর্ণিত নিষেধাজ্ঞার অন্তর্ভুক্ত এবং অবৈধ। এটি আবার দুই প্রকার :

১. সাবাবে মুহাররিক : অর্থাৎ এমন সাবাব যা পাপ কাজটি ঘটতে উদ্বুদ্ধ করে। যা না থাকলে পাপ কাজটি সংগঠিত হওয়ার বাহ্যিকভাবে অন্য কোন কারণ ছিল না। যেমন, কোন হিন্দুর দেবতাকে গালি দেওয়ার কারণে সে রাগান্বিত হয়ে আল্লাহকে গালি দিল। 

বিধান : এধরনের সাবাব নাজায়েজ ও হারাম।

২. নিকটবর্তী সাবাব তবে মুহাররিক নয় : অর্থাৎ এমন সাবাব যা পাপ কাজটি ঘটতে বা ঘটাতে উদ্বুদ্ধ করে না। বরং এর সহযোগিতা নিয়ে পাপকার্য সম্পাদনকারী নিজ ইচ্ছায় পাপ কাজ সম্পাদন করে। উদাহরণ স্বরূপ, এমন ব্যক্তির কাছে আঙ্গুর বিক্রি করা যে তা দিয়ে মদ তৈরি করবে। এমন ব্যক্তির কাছে ঘর ভাড়া দেওয়া, যে তাতে মন্দির বানাবে কিংবা গানের কনসার্ট করবে কিংবা সুদী ব্যাংক বানাবে।

বিধান : এই ধরনের নিকটবর্তী সাবাবের বিধান হল, যদি ব্যক্তির ইচ্ছাই থাকে পাপ কাজে সহযোগিতা করা, তাহলে এটা পাপ কাজে সহযোগিতার প্রথম প্রকারের অন্তর্ভুক্ত হয়ে নিশ্চিতভাবে হারাম। আর যদি পাপ কাজে সহযোগিতার ইচ্ছা না থেকে থাকে, তাহলে দুই অবস্থার একটি হবে।

ক. ব্যক্তির জানা ছিল না যে, তার বাড়িটি ভাড়া নিয়ে কোন পাপ কাজে ব্যবহার করা হবে। এমনটা হলে সে গুনাহগার হবে না।

খ. ভাড়া দেওয়ার সময় তার জানা ছিল যে, বাড়িটি পাপ কাজে ব্যবহার হবে। তাহলে তার জন্য এই ভাড়া দেওয়াটা মাকরুহ হবে।

এরপর যদি পাপ কাজটি সরাসরি ভাড়াকৃত বাড়ির সাথে সম্পৃক্ত হয়, অর্থাৎ বাড়িটি হুবহু আপন অবস্থায় রেখেই পাপ কাজটি সম্পাদন করা সম্ভব হয়, তাহলে এটি মাকরুহে তাহরীমী। যা হারামের একেবারে নিকটবর্তী। আর যদি পাপ কাজটি সম্পাদন করার জন্য ভাড়াগ্রহিতার পক্ষ থেকে বাড়িটিতে কিছু পরিবর্তন আনতে হয়, তাহলে এটি মাকরুহে তানযীহী।

লিখেছেন : মুহাম্মদ সানাউল্লাহ

তারিখ : ০৮/১০/২০২৪ ইং

Share:

Facebook
Twitter
Pinterest
LinkedIn
Scroll to Top