কুরআন ও হাদীসে হালাল-হারাম বিষয় দুটি অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে উল্লেখ হয়েছে। উপার্জন হালাল হওয়া ও হারামমুক্ত হওয়া ইসলামে নামায, রোযার মতো প্রথম সারির ফরয বিধানসমূহের পরই অন্যতম ফরয বিধান। নিম্নে এ বিষয়ে কুরআন ও হাদীস থেকে কিঞ্চিৎ আলোকপাত করা হলো।
হালাল পরিচিতি
শাব্দিক পরিচিতি:
‘হালাল’ শব্দটির মূল হলো حل (হিল্লুন)। মূল অর্থ: খুলে দেওয়া, উন্মুক্ত করা। পরবর্তী সময়ে শব্দটি বিভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়। তন্মধ্যে প্রসিদ্ধ অর্থ: ضد الحرام তথা বৈধ, বা হারামের বিপরীত।
পারিভাষিক পরিচিতি:
আল্লামা মুহাম্মদ আলী থানভী রহ. ‘হালাল’ এর পারিভাষিক পরিচয় লিখেছেন-
الحلال ما أباحه الكتاب والسنة بسبب جائز مباح
‘হালাল হলো, বৈধ কোনো কারণের ভিত্তিতে কুরআন-সুন্নাহ যার অনুমোদন দিয়েছে।’
হালালকে ‘জায়েয’ও বলা হয়।
মোটকথা, হালাল একটি শরীয়াহ বিধান। এটি শরীয়াহ অনুমোদনকে বোঝায়।
হারাম পরিচিতি
শাব্দিক পরিচিতি:
‘হারাম’ শব্দটির মূল, ح-ر-م (হা, রা ও মীম)। এর মূল অর্থ : المنع والتشديد তথা নিষেধ করা ও কঠোরতা করা। শব্দটির আরেকটি অর্থ: ضد الحلال তথা বৈধ বা হালালের বিপরীত। অর্থাৎ নিষিদ্ধ।
পারিভাষিক পরিচিতি:
ইমাম আবু বকর জাস্সাস রহ. ‘হারাম’ এর পরিচয় দিয়েছেন এভাবে,
المحظور ما يستحق بفعله العقاب وبتركه الثواب
‘হারাম বা নিষিদ্ধ বিষয় হলো, যা করার কারণে শাস্তির সম্মুখীন হতে হয় এবং ছেড়ে দেওয়ার দ্বারা প্রতিদান লাভ হয়।’
হারামকে ‘নাজায়েয’ও বলা হয়।
মোটকথা, হারাম একটি শরীয়াহ বিধান। এটি শরীয়াহ নিষিদ্ধতাকে বোঝায়। যা অমান্য করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
হালাল গ্রহণের গুরুত্ব: আল কুরআনুল কারীম থেকে
কুরআন মাজীদে মহান আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা অন্তত ৫টি আয়াতে অত্যন্ত স্পষ্ট ভাষায় অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে হালাল গ্রহণের আদেশ দিয়েছেন। যথা:
১. মানবজাতির সকলের প্রতি নির্দেশ:
يَۤا أَيُّهَا النَّاسُ كُلُوْا مِمَّا فِي الْأَرْضِ حَلَالًا طَيِّبًا وَلَاتَتَّبِعُوْا خُطُوَاتِ الشَّيْطَانِۚ إِنَّهُ لَكُمْ عَدُوٌّ مُّبِيْنٌ
‘হে মানবজাতি, পৃথিবীতে যা কিছু হালাল ও পবিত্র খাদ্যবস্তু রয়েছে তা থেকে তোমরা আহার করো এবং শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না। নিশ্চয় সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু।’ (সূরা বাকারা: ১৬৮)
উক্ত আয়াতে আল্লাহ সুবহানাহু হালাল রিয্ক গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছেন। এরপর বিশেষ করে শয়তানের অনুসরণ থেকে বেঁচে থাকতে আদেশ করেছেন। হারাম ভক্ষণ শয়তানের অনুসরণেরই একটি ক্ষেত্র। সুতরাং এর থেকে বেঁচে থাকতে হবে।
২. সকল ঈমানদারের প্রতি নির্দেশ:
يَۤا أَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوْا كُلُوْا مِنْ طَيِّبَاتِ مَا رَزَقْنَاكُمْ، وَاشْكُرْوْا لِلّٰهِ إِنْ كُنْتُمْ إِيَّاهُ تَعْبُدُوْنَ
‘হে মুমিনগণ, আমি তোমাদেরকে জীবিকারূপে যে উৎকৃষ্ট বস্তুসমূহ দিয়েছি, তা থেকে (যা ইচ্ছা) খাও এবং আল্লাহর শোকর আদায় করো, যদি সত্যিই তোমরা কেবল তাঁরই ইবাদত করে থাকো।’ (সূরা বাকারা : ১৭২)
উক্ত আয়াতে অত্যন্ত জোরালোভাবে হালাল গ্রহণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, তোমরা প্রকৃত অর্থে আল্লাহর বান্দা হয়ে থাকলে হালাল গ্রহণ করো। হারাম থেকে বেঁচে থাকো এবং এর জন্য শুকরিয়া আদায় করো।
আল্লামা ইবনে কাসীর রহ. এ আয়াতের তাফসীরে লিখেছেন, আল্লাহ তাআলা তাঁর মুমিন বান্দাদেরকে হালাল গ্রহণ ও হারাম বর্জনের আদেশ করেছেন যদি তারা তাঁর বান্দা হয়ে থাকে। হালাল গ্রহণ দোয়া ও ইবাদত কবুল হওয়ার মাধ্যম। অপরদিকে হারাম গ্রহণ দোয়া ও ইবাদত কবুল না হওয়ার কারণ। (তাফসীরে ইবনে কাসীর, দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ, বৈরুত, লেবানন, প্রথম সংস্করণ, ১৯৯৮ ইং., খ. ১, পৃ. ৩৫০)
৩. ব্যাপক নির্দেশ:
فَكُلُوْا مِمَّا رَزَقَكُمُ اللهُ حَلَالًا طَيِّبًا وَاشْكُرُوْا نِعْمَتَ اللهِ إِنْ كُنْتُمْ إِيَّاهُ تَعْبُدُونَ
‘আল্লাহ তোমাদেরকে হালাল ও পবিত্র যা কিছু দিয়েছেন তা থেকে তোমরা আহার করো এবং আল্লাহর অনুগ্রহের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো, যদি তোমরা কেবল তাঁরই ইবাদত করে থাকো।’ (সূরা নাহল: ১১৪)
৪. ব্যাপক নির্দেশ ও শাস্তির ভয়:
كُلُوْا مِنْ طَيِّبَاتِ مَا رَزَقْنَاكُمْ وَلَاتَطْغَوْا فِيْهِ فَيَحِلَّ عَلَيْكُمْ غَضَبِيْ وَمَنْ يَحْلِلْ عَلَيْهِ غَضَبِيْ فَقَدْ هَوَىٰ
‘তোমাদেরকে যা দান করেছি, তা থেকে ভালো ও হালাল বস্তু আহার করো এবং এই বিষয়ে সীমালঙ্ঘন করো না। করলে তোমাদের ওপর আমার ক্রোধ অবধারিত এবং যার ওপর আমার ক্রোধ অবধারিত সে তো ধ্বংস হয়ে যায়।’ (সূরা তহা: ৮১)
উক্ত সম্বোধন যদিও বনি ইসরাইলদের প্রতি, তবে এর ব্যাপকতায় উম্মতে মুহাম্মাদীও অন্তর্ভুক্ত। আয়াতের সারমর্ম হলো, আল্লাহ তাআলা তোমাদের জন্য যা হালাল করেছেন, যা স্বাস্থ্যের জন্য ভালো তা গ্রহণ করে। আর যেগুলো হারাম করেছেন তা থেকে বেঁচে থাকো। যদি কেউ তা অমান্য করে হারাম গ্রহণ করে, তাহলে এ সীমালঙ্ঘনের কারণে আল্লাহর আযাব চলে আসতে পারে। সাথে এটিও জেনে রাখো, যার ওপর আল্লাহর আযাব নাযিল হয়, তার ধ্বংস অনিবার্য। (বয়ানুল কুরআন, খ. ৩, পৃ. ১৪৬)
৫. নবীগণের প্রতি নির্দেশ:
يَۤا أَيُّهَا الرُّسُلُ كُلُوْا مِنَ الطَّيِّبَاتِ وَاعْمَلُوْا صَالِحًا إِنِّيْ بِمَا تَعْمَلُوْنَ عَلِيْمٌ
‘হে রাসূলগণ, তোমরা উত্তম বস্তু আহার করো ও নেক আমল করো, নিশ্চয় আমি তোমাদের আমল সম্পর্কে সম্যক অবহিত।’ (সূরা মু’মিনূন, আয়াত: ৫১)
এ আয়াত থেকে বোঝা গেল, সমস্ত নবী-রাসূলগণ হালাল গ্রহণ ও হারাম বর্জনের ব্যাপারে আল্লাহর পক্ষ থেকে আদিষ্ট ছিলেন। এ থেকে হালাল গ্রহণের গুরুত্ব আরো প্রকটভাবে প্রমাণিত হয়।
আল্লামা ইবনে কাসীর রহ. এ আয়াতের তাফসীরে লিখেছেন, ‘এ আয়াতে আল্লাহ তাআলা তাঁর সকল রাসূলকে হালাল গ্রহণ করতে আদেশ করেছেন। সাথে নেক কাজ করতেও বলেছেন। এতে প্রতীয়মান হয়,
إن الحلال عون على العمل الصالح فقام الأنبياء عليهم السلام بهذا أتم القيام
‘হালাল ভক্ষণ নেক ও সৎ কাজে সহায়ক। আম্বিয়া আলাইহিমুস সালামের ওপর পূর্ণরূপে আমল করেছেন।’ (তাফসীরে ইবনে কাসীর, খ. ৫, পৃ. ৪১৫)
সালাফ থেকে বর্ণিত আছে,
إذا أكلت الحلال أطعت الله شئت أو أبيت، وإذا أكلت الحرام عصيت الله شئت أو أبيت
‘যখন তুমি হালাল আহার করবে, তখন তুমি চাও বা না চাও তোমার মাধ্যমে আল্লাহর আনুগত্য হবেই। পক্ষান্তরে যখন তুমি হারাম খাবে, তখন তুমি চাও বা না চাও তোমার মাধ্যমে আল্লাহর নাফরমানি হবেই।’ (আল হিস আলাত তিজারাহ, পৃ. ৭)
লক্ষ্য করুন,
- একটি দুটি নয়; বরং ৫টি আয়াতে ‘হালাল’ গ্রহণের স্পষ্ট নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া আরো বিভিন্ন আয়াতে হালাল গ্রহণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ নির্দেশনা সারা জাহানের অধিপতি মহান আল্লাহর। বিভিন্ন আঙ্গিকে এসব আয়াতে হালাল গ্রহণের গুরুত্ব তুলে ধরা হয়েছে।
- হালাল গ্রহণ আল্লাহর অনুগ্রহ। তাই শুকরিয়া আদায় করারও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। শুকরিয়া আদায় হালাল গ্রহণের চেতনাকে শাণিত করে। অহংবোধ তৈরি হয় না। তাই শুকরিয়া আদায়ের বিকল্প নেই।
- দুই ও তিন নং আয়াতের এই- ‘যদি তোমরা সত্যিই কেবল তাঁরই ইবাদত করে থাক’ অংশটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সত্যিকার আল্লাহর বান্দা তারাই, যারা শত কষ্ট সত্তে¡ও মহান আল্লাহর উক্ত নির্দেশ পালনে সদা প্রস্তুত।
- পাঁচ নং আয়াত থেকে বোঝা গেছে, হালাল গ্রহণ নেক কাজের সহায়ক। শত ভালো নিয়ত থাকা সত্তে¡ও নেক ও ভালো কাজ অনেকের দ্বারা হয় না। না হওয়ার একটি অন্যতম কারণ কিন্তু ‘হারাম ভক্ষণ’!
হালাল গ্রহণের গুরুত্ব: সহিহ হাদীস থেকে
প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিভিন্ন হাদীসে হালাল গ্রহণের প্রতি গুরুত্বারোপ করেছেন। এ বিষয়ে কিছু সহিহ হাদীস নিম্নে পেশ করা হলো:
১. হালাল উপার্জন আবশ্যক:
হযরত আনাস বিন মালিক রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,
طلب الحلال واجب على كل مسلم
‘হালাল রুজি সন্ধান করা প্রত্যেক মুসলিমের ওপর অনিবার্য।’ (মাজমাউয যাওয়ায়েদ, হাদীস নং : ১৮০৯৯, হাদীসটির সনদের মান : হাসান।)
অবশ্য উপার্জনের বিভিন্ন স্তর রয়েছে। কখনো তা ফরয হয়, কখনো মুস্তাহাব হয়। এ বিষয়ে বিশদ আলোচনা সামনে করা হবে ইনশাআল্লাহ।
২. হালাল গ্রহণ দোয়া কবুলের পূর্বশর্ত:
হযরত আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন,
أيها الناس! إن الله طيب،لايقبل إلا طيبا، وإن الله أمر المؤمنين بما أمر به المرسلين، فقال : يا أيها الرسل كلوا من الطيبات واعملوا صالحا، إني بما تعملون عليم، وقال : يأيها الذين آمنوا كلوا من طيبات ما رزقناكم ثم ذكر الرجل يطيل السفر أشعث أغبر يمد يديه إلى السماء يارب يارب! ومطعمه حرام ومشربه حرام وملبسه حرام وغذي بالحرام فأنى يستجاب لذلك
‘হে লোকসকল, নিশ্চয় আল্লাহ পবিত্র। তিনি পবিত্রতা ছাড়া কিছু গ্রহণ করেন না। আল্লাহ তাআলা রাসূলদেরকে যে বিষয়ের আদেশ দিয়েছেন, মুমিনদেরকেও সে বিষয়ে আদেশ দিয়েছেন। আল্লাহ তাআলা বলেছেন, ‘হে রাসূল, পবিত্র বস্তু থেকে আহার করো এবং সৎকর্ম করো। নিশ্চয় আমি তোমাদের কৃতকর্ম সম্পর্কে জ্ঞাত।’ (সূরা মুমিনুন: ৫১)
অন্যত্র বলেছেন, ‘হে ঈমানদারগণ, আমি তোমাদেরকে যে উত্তম রিযিক দিয়েছি, তা থেকে আহার করো।’ (সূরা বাকারা: ১৭২)
এরপর নবীজি সা. এমন এক ব্যক্তির কথা আলোচনা করলেন, যে মরুভ‚মিতে দীর্ঘ সফর করেছে। যার চুলগুলো এলোমেলো। ধুলায় ধুসরিত। এ অবস্থায় সে আকাশের দিকে দুই হাত তুলে দোয়া করে বলে, ‘হে আমার প্রতিপালক, হে আমার প্রতিপালক!’ অথচ তার খাদ্য হারাম। পানীয় হারাম। পোশাক-পরিচ্ছদ হারাম। তার শরীর বেড়ে উঠেছে হারাম দ্বারা। অতএব, তার দোয়া কীভাবে কবুল করা হবে! (সহিহ মুসলিম: ১০১৫)
দেখুন, সফরে থাকা, অক্ষমতা, মুখাপেক্ষিতা ইত্যাদি দোয়া কবুলের সহায়ক বিভিন্ন উপাদান থাকা সত্তে¡ও শুধু হালাল গ্রহণ না করার কারণে দোয়া কবুল করা হয়নি। এটি ভাবার বিষয়। শুধু নেক কাজ করাই যথেষ্ট নয়; হারাম থেকে বেঁচে থাকাও জরুরি। ‘তার দোয়া কীভাবে কবুল করা হবে’ হাদীসে এ অংশটি বেশ ভাবার বিষয়। ‘দোয়া কবুল হবে না’ বলা হয়নি। নবীজি কতটা আশ্চর্য প্রকাশ করলেন! কত দৃঢ়তার সাথে বিষয়টি তুলে ধরলেন!
৩. হালাল গ্রহণের বিশেষ অসিয়ত:
হালালের গুরুত্ব সম্পর্কে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত সা’দ রা.-কে বিশেষভাবে অসিয়ত করার সময় ইরশাদ করেছেন,
يا سعد! أطب مطعمك تكن مستجاب الدعوة.
‘হে সা’দ, তুমি তোমার খাদ্যকে হালাল করো। তাহলে তুমি এমন হবে, যার দোয়া ফেরত দেওয়া হয় না।’ (মাজমাউয যাওয়ায়িদ, খ. ১০, পৃ. ৩৭৮, হাদীস : ১৮১০১)
হারাম বর্জনের গুরুত্ব: কুরআনুল কারীম থেকে
কুরআনুল কারীমে ইরশাদ হয়েছে,
يَۤاأَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوْا لَاتَأْكُلُوْا أَمْوَالَكُمْ بَيْنَكُمْ بِالْبَاطِل
‘হে ঈমানদারগণ, তোমরা অন্যায়ভাবে একে অপরের সম্পদ ভোগ করো না।’ (সূরা নিসা : ২৯)
আর্থিক বিষয়ে ‘আল আকলু বিল বাতিল’ একটি গুরুত্বপূর্ণ নিষিদ্ধ বিষয়। এর সরল অর্থ: ‘অন্যায়ভাবে সম্পদ ভোগ করা।’ ‘অন্যায়’ অর্থ: শরীয়াহ নিষিদ্ধ পথে সম্পদ ব্যবহার করা। চাই সেটি অন্যের সম্পদ হোক কিংবা নিজের হোক। নিজের সম্পদ অন্যায়ভাবে ভোগ করার অর্থ: পাপকাজে সম্পদ ব্যয় করা। সম্পদ হয়তো হালাল, হালাল পথে অর্জন হয়েছে কিন্তু ব্যয় করা হয়েছে হারাম কাজে। সেটিও উক্ত ‘আল-আকলু বিল-বাতিল’-এর অন্তর্ভুক্ত।
অন্যের সম্পদ অন্যায়ভাবে ভোগ করার অর্থ: চুরি, ডাকাতি, রিবা, খেয়ানত, জুয়া, ঘুষ, ইত্যাদি জুলুম পন্থায় সম্পদ উপার্জন করা। এর মধ্যে আরো আছে, বিনিময়হীন ভোগ। যেমন, বাস ভাড়া না দিয়ে নেমে পড়া। শ্রমিকের বেতন না দেওয়া। ইত্যাদি।
এর মধ্যে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, অন্যের অনুমোদন ছাড়া তার সম্পদ ব্যবহার করা। যেমন, সরকারী অফিসের ফোন ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করা। বন্ধু বা সহকর্মীর জিনিসপত্র তার অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করা। অর্থাৎ, এমন ব্যবহার যা সাধারণত অনুমোদনের মধ্যে পড়ে না।
আর্থিক লেনদেনের মাঝে আছে, ফাসেদ লেনদেন থেকে প্রাপ্ত মূল্য গ্রহণ করা। যেমন, কেউ ইচ্ছাকৃত নষ্ট কোনো পণ্য বা খাবার বিক্রয় করেছে। তাহলে বিক্রেতার জন্য এভাবে মূল্য গ্রহণ ও ব্যবহারও ‘আল আকলু বিল বাতিল’-এর অন্তর্ভুক্ত।
তদ্রূপ যেসব কাজ বৈধ নয়, সেসবের বিনিময় গ্রহণ করাও ‘আল আকলু বিল বাতিল’-এর অন্তর্ভুক্ত। যেমন, গান গেয়ে, নাচ করে, ব্যভিচার করে ইত্যাদি হারাম পথে উপার্জন। যদিও দাতার সম্মতি থাকে, তদুপরি সম্পদ উপার্জনের পথ যেহেতু নিষিদ্ধ, তাই প্রাপ্তিও নিষিদ্ধ। (পুরো আলোচনার মূল উৎস : আহকামুল কুরআন, জাস্সাস রহ., সূরা বাকারা : ১৮৮, খ. ১, পৃ. ৩০৩-৩০২, সূরা নিসা : ৩৩, খ. ২, পৃ. ২১৫-২১৬। প্রকাশক : যাকারিয়া বুক ডিপো, দেওবন্দ, ভারত।)
সুতরাং ইসলামে শুধু রিবা বা সুদ-ই হারাম নয়; ‘আল আকলু বিল বাতিল’ও হারাম। এ বিষয়ে আমাদের মধ্যে সচেতনতার ঘাটতি রয়েছে!
হারাম বর্জনের গুরুত্ব: সহিহ হাদীস থেকে
১. হারাম গ্রহণের চেয়ে মাটি খাওয়া ভালো:
হযরত আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
والذي نفسي بيده … لأن ياخذ أحدكم ترابا فيجعله في فيه، خير له من أن يجعل في فيه ما حرم الله عليه
‘সেই সত্তার শপথ, যার হাতে আমার প্রাণ, তোমাদের আল্লাহ যা হারাম করেছেন, এমন কিছু নিজ মুখে দেওয়ার চেয়ে মুখে মাটি দেওয়া অনেক ভালো।’ (মুসনাদে আহমাদ, মুআসসাতুল রিসালাহ, বৈরুত, লেবানন, দ্বিতীয় সংস্করণ, ২০০৮ ইং., খ. ২, পৃ. ২৫৭)
কোনো কিছুর গুরুত্ব ও নিশ্চয়তা বোঝানোর জন্য বাক্যে ‘কসম’ (শপথ) ব্যবহার করা হয়। এখানে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কসম শব্দ ব্যবহার করে, অত্যন্ত জোরালোভাবে হারাম বর্জনের প্রতি গুরুত্বারোপ করেছেন।
প্রকাশ থাকে যে, এটি জানা কথা, মাটি খাওয়া হয় না। উদ্দেশ্য হলো, সামান্য হালাল ডাল-ভাত হলেও সেটাই গ্রহণ করো। হারাম থেকে বিরত থাকো। ‘হারাম খাওয়ার চেয়ে মাটি খাওয়া ভালো।’ হাদীসের এই অংশটি মনে রাখার মতো।
২. জান্নাতে প্রবেশ নিষিদ্ধ:
খলিফায়ে রাশেদ আবু বকর রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন,
لا يدخل الجنة جسد غذي بحرام
‘সেই দেহ জান্নাতে প্রবেশ করবে না, যাকে তৃপ্ত করা হয়েছে হারাম দ্বারা।’ (মাজমাউয যাওয়ায়েদ, খ. ১০, পৃ. ৩৮০)
হযরত কা’ব ইবনে উজরাহ রা. থেকে বর্ণিত, নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন,
كل لحم نبت من الحرام فالنار أولى به
‘প্রত্যেক গোশত বা দেহ যা হারাম দ্বারা বৃদ্ধি হয়েছে, তার জন্য জাহান্নামের আগুনই অধিক উপযুক্ত।’ (আল হাছছু আলাত তিজারাহ, ভূমিকা, পৃ. ৮)
৩. সম্পদের হিসাব প্রদান:
আবু বারযাহ আসলামী রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন,
لاتزول قدما عبد يوم ا لقيامة حتى يسئل عن عمره فيم أفناه، وعن علمه فيم فعل، وعن ماله من أين اكتسبه وفيم أنفقه، وعن جسمه فيم أبلاه
‘কিয়ামতের দিন কারো দুই পা সামনে অগ্রসর হবে না, যতক্ষণ না তাকে তার জীবন সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে- কীভাবে সেটা ব্যবহার করেছে। তার ইল্ম সম্পর্কে তাকে জিজ্ঞাসা করা হবে- সে অনুযায়ী আমল করেছে কি না। তার সম্পদ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে- কোথা থেকে তা উপার্জন করেছে ও কোথায় তা ব্যয় করেছে। তার দেহ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে- কীভাবে তা ক্ষয় হয়েছে।’ (জামে তিরমিযী, হাদীস নং ২৪১৭)
উক্ত হাদীস থেকে জানা গেল, সম্পদ অর্জন ও ব্যয়কারীদের তিনটি অবস্থা হতে পারে। যথা,
- ক. যারা হারাম পন্থায় সম্পদ উপার্জন করেছে।
- খ. যারা হালাল পন্থায় সম্পদ উপার্জন করেছে তবে ব্যয় করেছে হারাম কাজে। এই দুই শ্রেণির সম্পদশালী ধ্বংস হবে।
- গ. যারা হালাল পথে উপার্জন করেছে ও তা ব্যয়ও করেছে হালাল কাজে। কেবল এ শ্রেণির সম্পদশালী সফল হবে।
এ হাদীসে আরো একটি বিষয় লক্ষণীয়, যে ৫টি বিষয়ে জিজ্ঞাসা করার কথা বলা হয়েছে, এর মধ্যে দুটিই অর্থনৈতিক বিষয়ে। এর অর্থ ৪০ শতাংশ প্রশ্ন হবে অর্থনীতি নিয়ে। ভাবার বিষয় হলো, আমরা বাস্তব জীবনে এ নিয়ে কত শতাংশ চিন্তিত!!
সারকথা :
উপরোল্লিখিত আয়াত ও হাদীস থেকে এটি অত্যন্ত পরিষ্কার যে, একজন মুমিন হিসাবে আয়-রোজগারে হারাম থেকে বেঁচে থাকতে হবে, হালালের ওপর চলতে হবে। হারাম উপার্জন অত্যন্ত নিন্দিত। এর ঠিকানা জাহান্নাম। অতএব প্রত্যেক মুমিনের চিন্তা করা উচিত, তার উপার্জনে কোনো হারাম আছে কি না। শরীয়াহ্ বিশেষজ্ঞ কারো সাহায্যে নিজের যাবতীয় আয়-উপার্জন শরীয়াহ্ চেকিং করিয়ে নেওয়া জরুরি।
হালাল উপার্জনের গুরুত্ব: শায়খ আব্দুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ রহ.-এর সারগর্ভ বক্তব্য
আল্লামা শায়খ আব্দুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ রহ. (১৩৩৬ হি.-১৪১৭ হি./১৯১৭-১৯৯৭ খ্রি.) ছিলেন আরবের নিকট অতীতের বিখ্যাত মনীষী আলেম। তিনি একাধারে হাদীস বিশারদ, ফকিহ, আরবী ভাষাবিদ, মুহাক্কিক, ইসলামী চিন্তাবিদ, বস্তুনিষ্ঠ লেখক ছিলেন। ব্যবসা-বাণিজ্যে উদ্বুদ্ধ করণ বিষয়ে ইমাম ইবনে খাল্লাল রহ. (৩১১ হি.)-এর একটি গ্রন্থের সম্পাদনা করতে গিয়ে এর ভ‚মিকায় তিনি বর্তমান সময়ে উপার্জনে হালাল-হারাম বিষয়ে একটি সারগর্ভ বক্তব্য পেশ করেছেন। গুরুত্বের বিবেচনায় বক্তব্যটির সারমর্ম পাঠকদের জন্য পেশ করা হলো-
‘বর্তমান সময়ে প্রায় সবাই উপার্জনের কোনো না কোনো পন্থায় লেগে আছে। বরং এতো বেশি একে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে, যা আগে কখনো হয়নি। তাদের একমাত্র লক্ষ্য হয়ে আছে আর্থিক সমৃদ্ধি অর্জন। ফরয ও ওয়াজিব ইবাদতের ওপরও একে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। তাই এখন আর কাউকে উপার্জনে সম্পৃক্ত হওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করার তেমন প্রয়োজনীয়তা নেই।
এখন মানুষের সবচেয়ে প্রয়োজনীয় বিষয় হলো, তাদেরকে হারাম উপার্জন থেকে সতর্ক করা। এখন তো সুদ, ঘুষ, ছিনতাই, সিন্ডিকেট, মিথ্যা, প্রতারণা, যাকাত না দেওয়া ইত্যাদি সকল অন্যায় কাজে সমাজ ছেয়ে গেছে। এসব কারণে মানুষের চরিত্র কলুষিত হচ্ছে। সমাজ থেকে ভ্রাতৃত্ববোধ উঠে যাচ্ছে। পরকালের ওপর ইহকালকে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। সুতরাং মানুষকে এসব ধ্বংসাত্মক কাজ থেকে সতর্ক করা এখন খুবই জরুরি।
যার উপার্জনে হারাম ঢুকে যায়, তার থেকে আল্লাহর আনুগত্য, ভালো কাজের আশা করা যায় না। কারণ খারাপ কাজ সবসময় খারাপের দিকেই আহ্বান জানায়। বিশেষত যখন খাদ্য হারাম থাকে, তখন বিষয়টি আরো ভয়াবহরূপ দান করে। সুতরাং আমাদের মধ্যে থেকে কারো ব্যাপারে যদি দেখা যায়, তার চরিত্রে, চলনে সমস্যা আছে, আল্লাহর আনুগত্য করে না, পাপাচারে লিপ্ত, তাহলে তুমি তার উপার্জনের উৎস তালাশ করে দেখো, তাতে হারাম আছে। কারণ হারাম সম্পদ মানুষের চরিত্র কলুষিত করে, আল্লাহ থেকে দূরে সরিয়ে রাখে।’ (আল হাছছু আলাত তিজারাহ, ভ‚মিকা, পৃ. ৭)
হালাল উপার্জনের গুরুত্ব: শায়খুল ইসলাম মুফতি তাকী উসমানী হাফি.-এর মূল্যবান ভাষ্য
শায়খুল ইসলাম মুফতি তাকী উসমানী হাফিযাহুল্লাহ। বর্তমান সময়ে মুসলিম বিশ্বের প্রথম সারির বিশ্ব নন্দিত আলেমদের অন্যতম। তিনি এক বয়ানে বলেছেন-
‘কেউ যদি সর্বদা এই ফিকির ও চিন্তা নিয়ে চলে যে, তার উপার্জনে যেন এক টাকাও হারাম না ঢুকে। তাহলে ইয়াকীন ও বিশ্বাস রাখুন, যদি ওই লোক জীবনে কোনো নফল নামাযও না পড়ে, নিয়মিত যিকির-তাসবীহও আদায় না করে, বরং নিজেকে হারাম উপার্জন থেকে রক্ষা করে কবর পর্যন্ত চলে যায়, তাহলে ইনশাআল্লাহ সে সোজা জান্নাতে যাবে। আর যদি এমন হয় যে, হালাল-হারামের কোনো ফিকির নেই। তবে তাহাজ্জুদ মিস হয় না। যিকির-তাসবীহ নিয়মিত হয়। তাহলে এসব নফল ইবাদত তাকে হারাম উপার্জনের আযাব থেকে রক্ষা করতে পারবে না।’ (ইসলাহী খুতুবাত, খ. ১০, পৃ. ১৭৪)
সালাফ ও উপার্জনে হালাল-হারাম
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেন, العبادة مع أكل الحرام كبنيان على السرقين ‘হারাম খাদ্য গ্রহণ করে ইবাদত করা মূলত গোবরের ওপর ইমারত নির্মাণের মতোই।’ (আল হাছছু আলাত তিজারাহ, ভ‚মিকা, পৃ. ৪৩)
বোঝা গেল, হারাম উপার্জন এমন একটি ধ্বংসাত্মক বিষয় যে এর সাথে সম্পৃক্ত থেকে ইবাদতেরও প্রত্যাশিত মূল্য পাওয়া যায় না।
এজন্য সালাফের উলামায়ে কেরাম বলেছেন, أعلى الورع ترك الحلال مخافة الحرام ‘সর্বোচ্চ তাকওয়া হলো হারামের ভয়ে হালালও ছেড়ে দেওয়া।’ (ইরশাদুস সারী লি শারহি সহীহিল বুখারী, খ. ১, পৃ. ১৯১)
সুতরাং যেকোনো লেনদেনে সম্পৃক্ত হওয়ার আগে, সেটি হালাল কি না তা বিজ্ঞ আলেম থেকে নিশ্চিত হয়ে নেওয়া জরুরি।
হালাল গ্রহণের নগদ ফায়দা হলো, অন্তর নরম হয়ে যাওয়া। এতে আল্লাহর নাফরমানি ও অবাধ্যতা থেকে বিরত থাকা সহজ হয়। মানুষের সাথে সদাচারণ বৃদ্ধি হয়। ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল রহ.-কে জিজ্ঞাসা করা হলো, بما تلين القلوب؟ قال: بأكل الحلال. ‘অন্তরসমূহ নরম হয় কিসে? জবাবে ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল রহ. বললেন, হালাল গ্রহণের মাধ্যমে। (তাবাকাতু হানাবেলা, ইবনে আবি ইয়ালা, খ. ১, পৃ. ২১৯)
হযরত ইব্দুল্লাহ ইবনে মুবারক রহ. বলেছেন-رد درهم من شبهة أحب إلى من أن أتصدق بمئة ألف درهم. ‘সন্দেহযুক্ত একটি দিরহাম ছেড়ে দেওয়া আমার কাছে লক্ষাধিক দিরহাম দান করার চেয়েও প্রিয় ও অগ্রগণ্য।’ (প্রাগুক্ত)
সালাফের নারীদের রীতি ছিল, তাদের স্বামীরা যখন উপার্জনের উদ্দেশ্যে ঘর থেকে বের হতো, তখন তারা তাদেরকে এই বলে বিদায় দিতেন,اتقوا الله فينا ولا تطعمونا الكسب الحرام، فإنا نصبر على الجوع والضر ولا نصبر على النار. ‘আমাদের ব্যাপারে তোমরা আল্লাহকে ভয় করো। আমাদেরকে হারাম কিছু খাওয়াবে না। জেনে রাখো, আমরা আর্থিক সংকটের কারণে ক্ষুধা ও কষ্টের ওপর সবর করতে প্রস্তুত। তবে (হারাম খেয়ে) আখেরাতের আগুনে আমরা সবর করতে পারব না।’ (ইয়াহইয়া উলুমুদ্দিন, ইমাম গাযালী রহ., বিবাহ শিষ্টাচার অধ্যায়, শেষাংশ।)
ইমাম ইবনে সিরীন রহ. অত্যন্ত চমৎকার কথা বলেছেন। বান্দার রিযিক বরাদ্দ হয়ে আছে। কে কতটুকু পাবে তা আগে থেকে সুনির্দিষ্ট। সুতরাং আমাদের উচিত, হালাল অন্বেষণ করা। কারণ হারাম গ্রহণ করেও আমি আমার বরাদ্দের অধিক পাব না।
হাম্বলী মাযহাবের একজন আল্লাহওয়ালা ফকিহ। ইবনে হামেদ আল-ওয়াররাক। তিনি নিজ হাতে কামাই করতেন। পারিশ্রমিকের বিনিময়ে মানুষের নানা গ্রন্থ হাতে অনুলিপি করে দিতেন। সেই লব্ধ অর্থ দিয়ে হজ করতেন। অনেক হজ করতেন। বয়স হওয়ার পরও হজ করতেন। এক হজে¦র সফরে পথিমধ্যে তাঁর প্রচুর পানির পিপাসা হয়। পিপাসার তীব্রতায় তাঁর প্রাণ প্রায় ওষ্ঠাগত ছিল। তখন এক হাজী অল্প কিছু পানি নিয়ে আসল। এরকম কঠিন সময়ে তিনি সেই হাজীকে বললেন, এই পানি কোত্থেকে এনেছেন? আগত হাজী বলল, আপনার প্রাণ যায়যায় অবস্থা। এ পরিস্থিতিতেও এরকম প্রশ্ন করছেন! জবাবে ইবনে ওয়াররাক রহ. বললেন, হ্যাঁ, ভাই। এটিও প্রশ্ন করার সময়। এ সময়তো আল্লাহর সাথে সাক্ষাতের সময়। এ সময়েও আমার জানা দরকার পানির উৎস কি। ঐতিহাসিকগণ বলেছেন, এরপর ওই সফরেই তাঁর ইন্তেকাল হয়ে যায়। (তাবাকাতে হানাবেলা, খ.২, পৃ.১৭৭)
এ ছিল সালাফের রীতি। জীবনের শেষ মুহূর্তেও উপার্জনে হারাম যেন না ঢুকে এ ব্যাপারে পূর্ণ সচেতন ছিলেন।
আমরা অনেক সময় হারাম পথে উপার্জন করি। ভাবি, আমার সামনে তো হালাল পথ নেই। অথচ বাস্তবতা হলো কেউ যদি আল্লাহর ভয়ে হারাম পরিত্যাগ করে, তাহলে আল্লাহ তাআলা তাকে হালালের পথ বের করে দেন। ইবনে আতা উল্লাহ ইসকান্ধারী রহ. বলেছেন, جل ربنا أن يعامله العبد نقداً فيجازيه نسيئة ‘বান্দা নগদ হারাম পরিত্যাগ করবে, আর আল্লাহ সুবহানাহু তাকে বাকিতে প্রতিদান দিবেন, এমন হবে না।’ (রিসালাতুল মুসতারশিদীন, পৃ. ৯১। শায়খ আব্দুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ রহ. এর টীকা থেকে সংগৃহিত।)
শায়খ আব্দুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ রহ. লিখেছেন, من عف عن الحرام تديناً، رزقه الله إياه حلالاً ‘শরীয়তের বিধান পালন করতে যেয়ে যে হারাম থেকে বেঁচে থাকবে, আল্লাহ তাআলা তাকে এর পরিবর্তে হালালের ব্যবস্থা করে দিবেন।’ এ প্রসঙ্গে তিনি কিছু ঐতিহাসিক ঘটনাও উল্লেখ করেছেন। (প্রাগুক্ত, পৃ. ৮৭-৯১)
মোটকথা, হারাম থেকে বেঁচে থাকা মহান আল্লাহর বিধান। এর থেকে বেঁচে থাকতে-ই হবে। হালালের মাধ্যমেই আমাদের অর্থনীতির সার্বিক সমাধান খুঁজতে হবে। হালাল কখনই অসম্ভব নয়। হ্যাঁ, হালালের জ্ঞান ও অনুসন্ধানে আমাদের ত্রæটি থাকার কারণে কখনো মনে হতে পারে সব কিছুই হারাম। এ যুগে হালাল অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করা সম্ভব নয়। এ ধারণা একেবারেই গলদ।
প্রসঙ্গক্রমে ইমাম বুখারী রহ.-এর আলোচনা আমাদের দেশে বেশ প্রসিদ্ধ। তাই তাঁর জীবনী থেকে হালালের পাঠের কিছু অংশ পাঠকবৃন্দের খেদমতে তুলে ধরা হলো। আশা করি হাদীসের ক্ষেত্রে যেমন এই মনীষী আলেমকে আমরা শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি, হালাল গ্রহণের ক্ষেত্রেও তাঁর জীবনী থেকে প্রেরণা লাভ করব।
ইমাম বুখারী রহ. ও তাঁর অর্থনৈতিক জীবন
ইমাম আবু আব্দুল্লাহ মুহাম্মাদ ইবনে ইসমাইল আল-বুখারী রহ. (১৯৪-২৫৬ হি.) এর নাম কে না শুনেছে। জগদ্বিখ্যাত হাদিস বিশারদ। সহিহুল বুখারী তাঁর অনবদ্য সংকলন।
তাঁর জীবনের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা হয়। আজ তাঁর জীবনের অর্থনৈতিক কিছু দিক তুলে ধরব। কিভাবে তিনি তাঁর জীবনে, পরিবারে হালাল নিশ্চিত করতেন। কি পরিমাণ অন্যের আর্থিক হক ও হালালের প্রতি সতর্ক ছিলেন ইতিহাসের পাতা থেকে এর কিঞ্চিৎ তুলে ধরার ছোট্ট প্রয়াস এই লেখা। হাদীসের ইমাম হিসাবে যেমন তাকে সম্মান করি, অনুসরণ করি, হালাল জীবন গড়তেও তাঁকে অনুসরণ করতে পারি।
হারামমুক্ত পরিবার
ইমাম বুখারী রহ.-এর পিতা ইসমাইল রহ. ছিলেন একজন হালালমুখী মানুষ। তাঁর উপার্জনে কোনো ধরনের হারাম, এমনটি সন্দেহজনক কিছুও ছিল না। ইমাম আহমাদ ইবনে হাফস রহ. বলেন, আমি তাঁর পিতা ইসমাঈলের মৃত্যুর সময় উপস্থিত ছিলাম। ইন্তেকালের আগ মুহূর্তে তিনি বলছিলেন,
لا أعلم من مالي درهماً من حرام ولا درهما من شبهة
‘আমার সম্পদে এক দিরহাম/টাকা হারাম আছে কিংবা অন্তত সন্দেহজনক কিছু আছে বলে আমার জানা নেই।’
ইমাম ইবনে হাফস রহ. বলেন, আমি তাঁর কথা শুনে কিছুটা অবাক হলাম। ইমাম বুখারী রহ.-কে বললে তিনি বললেন, أصدق ما يكون الرجل عند الموت ‘মানুষ মৃত্যুর সময় যা বলে তা সত্যই বলে।’ (সিয়ারু আলামিন নুবালা, খ. ১০, পৃ. ৩০৭)
এরকম একটি হালাল পরিবারেই আমাদের ইমাম বুখারী রহ. বেড়ে উঠেছেন।
ইমাম বুখারী রহ.-এর আমানতদারিতা
ইমাম বুখারী রহ. অন্যের আমানতের প্রতি বেশ যতœশীল ছিলেন। তিনি দীর্ঘ সময় ভাড়া বাসায় ছিলেন। একদা তিনি বললেন, আমি সেই ভাড়া বাড়ির প্রতি যতœশীল ছিলাম। বাড়ির দেয়াল, ফ্লোর ব্যবহারে সতর্ক ছিলাম। কারণ ঘরটি আমার নয়। অন্যের। (প্রাগুক্ত)
আজ আমাদের অবস্থা বড়ই করুন। ভাড়াটিয়ারা ইচ্ছেমতো বাসার দেয়াল, ফ্লোর ব্যবহার করে। এতে বাড়ির ক্ষতি হলো কি না তা খেয়াল করা হয় কম। অথচ এগুলো ভাড়াটিয়ার প্রতি বাসার মালিকের আমানত। এর প্রতি যত্নশীল না হলে সূক্ষ্ম ‘হারাম’ নিজের সম্পদে ঢুকে যেতে পারে।
ক্রয়-বিক্রয়ে ও অন্যের হকের প্রতি সতর্কতা
ইমাম বুখারী রহ. ক্রয়-বিক্রয়ে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করতেন। অন্যের সামান্যতম হকও যেন তার ওপর অনাদায়ী না থাকে, সে ব্যাপারে সর্বোচ্চ খেয়াল রাখতেন।
একবার তিনি তাঁর বেশ কিছু দ্রব্যসামগ্রী বিক্রয়ের ইচ্ছে করলেন। রাতের বেলা একদল ব্যবসায়ী এসে তা ক্রয়ের ইচ্ছে প্রকাশ করল। তিনি বললেন, পরদিন আসতে। পরদিন আরেক ব্যবসায়ী দল আরো অধিক মূল্যে তা ক্রয়ে আগ্রহী হলো। তিনি বললেন, না, রাতে যারা আসছে, তাদের কাছেই আমি তখন বিক্রয় করে দেওয়ার নিয়ত করেছি। সুতরাং এখন আপনাদের কাছে তা আমি বিক্রয় করতে পারব না। (প্রাগুক্ত)
আল্লাহর পক্ষ থেকে সাহায্যপ্রাপ্তি
ইমাম বুখারী রহ. বলেন, আমি একবার আদম ইবনে আবি ইয়াসের কাছে গেলাম। পথিমধ্যে আমার চরম অর্থ সংকট দেখা দেয়। এমনকি ক্ষুধার তাড়নায় আমি ঘাস/তৃণলতা খাওয়া শুরু করেছি। তারপরও কারো কাছে আমার অক্ষমতার কথা প্রকাশ করিনি।
এভাবে তিন দিন হয়ে যায়। তৃতীয় দিন হঠাৎ দেখি, এক অচেনা লোক এসেছে। হাতে অনেকগুলো স্বর্ণ মুদ্রার এক থলে। আমাকে তা দিয়ে বললেন, আপনি তা খরচ করুন। (প্রগুক্ত)
সুবহানাল্লাহ, এ ঘটনায় আমাদের অর্থনৈতিক জীবনে কত বড় শিক্ষা রয়েছে!
ইলমের জন্য উপার্জন ও ব্যয়
ইমাম বুখারী রহ. নিজের জীবনকে ইলমের জন্য উৎসর্গ করেছিলেন। প্রতি মাসে তিনি ৫০০ দিরহাম উপার্জন করতেন। নিয়ত শুধু ইলমের পেছনে ব্যয় করা। এভাবে তিনি উপার্জনের একটি বৃহৎ অংশ ইলমের জন্য খরচ করতেন। (প্রাগুক্ত)
আমরা আমাদের জীবনেও কিছু অর্থ দীনের প্রয়োজনীয় ইলম অর্জনে ব্যয় করতে পারি।
আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে ইমাম বুখারী রহ.-এর অর্থনৈতিক ও হালাল জীবন থেকে পাথেয় গ্রহণ করার তাওফিক দান করুন। আমীন।
আর্টিক্যালটির পিডিএফ ভার্সন পড়তে ক্লিক করুন- হালাল ও হারাম, পরিচিতি ও প্রয়োজনীয়তা
লিখেছেন-
মুফতী আব্দুল্লাহ মাসুম হাফিজাহুল্লাহ
প্রধান মুফতী ও শিক্ষা সচিব, মারকাযু দিরাসাতিল ইকতিসাদিল ইসলামী
সিনিয়র সহকারী মুফতি, জামিয়া শারইয়্যাহ মালিবাগ, ঢাকা
প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক, আইএফএ কনসালটেন্সি