Motivational Inspirational Quote Instagram Post with Feather

ব্যবসায় নৈতিকতা : হাদীস ও আসারের আলোকে

ইসলাম পূর্ণাঙ্গ দ্বীন। মানবজীবনে ইহকাল ও পরকালের প্রতিটি বিষয়ে ইসলামের পরিপূর্ণ নির্দেশনা রয়েছে। ইসলাম অন্ধকাচ্ছন্ন পৃথিবীতে আলো জ্বালিয়েছে। মানুষকে ন্যায় ও ইনসাফের শিক্ষা দিয়েছে। নৈতিকতার শিক্ষা দিয়েছে। ইবাদতে নৈতিকতা, মুআশারাতে নৈতিকতা, পরস্পরের মুআমালায় নৈতিকতা। ইসলাম বলেছে, “হে মুমিনগণ, তোমরা একে অপরের সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করো না। তবে পরস্পরের সন্তুষ্টির মাধ্যমে ব্যবসা করতে পার।” -সূরা নিসা : ২৯

ইসলাম ব্যবসায় মানুষকে নৈতিকতার শিক্ষা দিয়েছে। ব্যবসা মানুষের সম্পদ উপার্জনের অন্যতম মাধ্যম। ইসলামপূর্ব যুগেও ব্যবসায়ের প্রচলন ছিল। জাহেলী যুগেও ছিল। মানুষ বিভিন্ন পন্থায় লেনদেন করত। দেশে বিদেশে বানিজ্য করত। ইসলাম সেগুলোকে নিষিদ্ধ করেনি। বরং কিছু নিয়ম-নীতি বেঁধে দিয়েছে। যা ব্যবসায় নৈতিকতা রক্ষা করতে সাহায্য করে। ইসলাম বলেছে, ব্যবসায় কাউকে ধোঁকা দেওয়া যাবে না, প্রতারণা করা যাবে না, ওজনে কম দেওয়া যাবে না। 

ইসলামে ব্যবসায়ের মূলনীতি : 

১/ উভয় পক্ষের সন্তুষ্টি থাকা : 

ব্যবসায় ক্রেতা বিক্রেতা উভয় পক্ষের সন্তুষ্টি আবশ্যক। পবিত্র কুরআনের ভাষ্য, 

يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَأْكُلُوا أَمْوَالَكُمْ بَيْنَكُمْ بِالْبَاطِلِ إِلَّا أَنْ تَكُونَ تِجَارَةً عَنْ تَرَاضٍ مِنْكُمْ

হে মুমিনগণ, তোমরা একে অপরের সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করো না। তবে পরস্পরের সন্তুষ্টির মাধ্যমে ব্যবসা করতে পার।” -সূরা নিসা : ২৯

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, لا يحل مال امرئ إلا بطيب نفس منه “কারো সম্পদ অপরের জন্য বৈধ নয় তার সন্তুষ্টি ছাড়া। -মুসনাদে আহমাদ : ২০৬৯৫

২/ ওয়াদা রক্ষা করা :

ওয়াদা রক্ষা করা ইসলামের একটি অন্যতম বিধান। সকল ক্ষেত্রেই ওয়াদা রক্ষা করা ওয়াজিব। বিশেষত পরস্পর লেনদেনের ক্ষেত্রে। পবিত্র কুরআনের এরশাদ, 

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أَوْفُوا بِالْعُقُودِ

হে ঈমানদারগণ, তোমরা ওয়াদা পূর্ণ করো। -সূরা মায়েদা : ১

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ওয়াদা ভঙ্গ করাকে মুনাফিকের আলামত বলেছেন। হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, “মুনাফিকের আলামত তিনটি : ১/ মিথ্যা বলা, ২/ ওয়াদা ভঙ্গ করা, ৩/ আমানতের খেয়ানত করা।” -সহীহ মুসলিম : ৫৯

৩/ ক্রয় বিক্রয়ে ‘গারার’ তথা অস্পষ্টতা, ধোঁকা ও প্রতারণা থেকে বিরত থাকা : 

হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ‘গারার’ সম্বলিত ক্রয় বিক্রয় থেকে নিষেধ করেছেন। -সহীহ মুসলিম : ১৫১৩

জাহেলী যুগে মানুষ বিভিন্ন ধরনের ‘গারার’ সম্বলিত লেনদেন করত। তারা ‘বাইউল হাসাত’ করত। ‘বাইউল হাসাত’ হল, কংকর নিক্ষেপ করে পণ্য ক্রয় করা। বিক্রেতা পণ্য সাজিয়ে রাখবে, ক্রেতা পণ্য লক্ষ্য করে পাথর নিক্ষেপ করবে, যে পণ্যে কংকর পড়বে, তা ক্রয় করা আবশ্যক হয়ে যাবে। কোন প্রকার ইচ্ছাধিকার থাকবে না। এমনিভাবে তারা ‘মুলামাসা’ ‘মুনাবাযা’ ইত্যাদী ‘গারার’ সম্বলিত লেনদেন করত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এধরনের ক্রয় বিক্রয় থেকে কঠোরভাবে নিষেধ করেন। 

এভাবে ইসলাম ব্যবসার ক্ষেত্রে এমন কিছু নীতিমালা শিখিয়ে দিয়েছে, যা অনুসরণ করলে ব্যবসায় বরকত হবে। অর্থনৈতিক উন্নতি সাধন হবে। সমাজে স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠিত হবে। নিম্নে ইসলামের দৃষ্টিতে একজন নীতিবান ব্যবসায়ীর কী কী গুণাবলি হওয়া উচিত, তার সংক্ষিপ্ত বিবরণ পেশ করা হলো।

একজন নীতিবান ব্যবসায়ীর গুণাবলি : 

১. মাপে কম না দেওয়া :

পবিত্র কুরআনে এসেছে, “দুর্ভোগ তাদের জন্য যারা মাপে কম দেয়, যারা লোকদের থেকে মেপে নেওয়ার সময় পূর্ণমাত্রায় গ্রহণ করে, আর যখন তাদের জন্য পরিমাপ করে তখন কমিয়ে দেয়। তারা কি চিন্তা করে না যে, তারা পুনরুত্থিত হবে? এক মহাদিবসে, যেদিন সমস্ত মানুষ রব্বুল আলামীনের সামনে দাঁড়াবে।” -সূরা মুতাফফিফীন : ১-৬

২. মিথ্যা কসম না করা :

হযরত আবু কাতাদা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, 

إياكم وكثرة الحلف في البيع، فإنه ينفق، ثم يمحق 

“তোমরা বেচাকেনায় অত্যাধিক কসম করা থেকে বেঁচে থাক, কেননা তা পণ্যকে বাজারে অচল করে দেয়, আর ব্যবসার বরকতকে নষ্ট করে দেয়।” -সহীহ মুসলিম : ১৬০৭

৩. ‘ইহতিকার’ না করা : 

‘ইহতিকার’ বলা হয়, মূল্য বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে পণ্য গুদামজাত করে রাখা। হাদীসে একে হারাম সাব্যস্ত করা হয়েছে। হযরত মা‘মার ইবনে আব্দুল্লাহ রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, ‌

لا ‌يحتكر ‌إلا ‌خاطئ

“পাপিরাই কেবল ইহতিকার করে।” -সহীহ মুসলিম : ১৬০৫

ইমাম নববী রহ. বলেন, এই হাদীসে সুস্পষ্টভাবে ‘ইহতিকারকে’ হারাম সাব্যস্ত করা হয়েছে। -শরহে মুসলিম, নববী, ১৬০৫ নং হাদীসের অধিনে

৪. ‘নাজাশ’ থেকে বিরত থাকা :

‘নাজাশ’ বলা হয়, কেনার উদ্দেশ্য ছাড়া দাম বাড়ানোর জন্য দরদাম করা, যাতে অন্যান্য ক্রেতারা ধোঁকাগ্রস্ত হয় এবং বেশি দামে কিনতে বাধ্য হয়। হাদীসে এ থেকে সুস্পষ্টভাবে নিষেধ করা হয়েছে। ইবনে উমর রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ‘নাজাশ’ থেকে নিষেধ করেছেন। -সহীহ বুখারী : ২১৪২

৫. তাকওয়া অবলম্বন করা : 

হযরত রিফাআ ইবনে রাফে রা. থেকে বর্ণিত, একদা তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে মসজিদে যাচ্ছিলেন। নবীজী দেখলেন লোকেরা বেচাকেনা করছে। নবীজী সবাইকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে ডাকলেন, يا معشر التجار “হে ব্যবসায়ীরা!” সবাই নবীজীর ডাকে সাড়া দিল। নবীজী বললেন,

إن التجار يبعثون يوم القيامة فجارا، إلا من اتقى الله، وبر، وصدق

“নিশ্চয় কেয়ামতের দিন ব্যবসায়ীদেরকে অপরাধী হিসাবে উঠানো হবে, তবে যারা তাকওয়া অবলম্বন করেছে, নৈতিকতা ও সততা অবলম্বন করেছে তারা ব্যতিত।” -সুনানে তিরমিযি : ১২১০

৬. সততা ও আমানতদারিতা রক্ষা করা : 

একজন নীতিবান ব্যবসায়ীর প্রধান গুণ হচ্ছে আমানতদার হওয়া। সতাতা এবং আমানতদারিতা ব্যবসায় বরকত ও উন্নতির প্রধান চবিকাঠি। কথায় আছে, “সততাই ব্যবসার মূল ধন”। সত্যবাদী ও আমানতদার ব্যবসায়ীর ফযীলত হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। হযরত আবু সাঈদ খুদরী রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, 

التاجر الصدوق الأمين مع النبيين، والصديقين، والشهداء 

“সত্যবাদী আমানতদার ব্যবসায়ী জান্নাতে নবীগণ, সিদ্দিকগণ এবং শহীদগণের সাথে থাকবে।” -সুনানে তিরমিযি : ১২০৯

৭. উদার ও মহানুভব হওয়া :

হযরত জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, 

رحم الله رجلا سمحا، إذا باع، وإذا اشترى، وإذا اقتضى 

“আল্লাহ তাআলা এমন ব্যক্তির প্রতি রহম করুন, যে ক্রয় বিক্রয়ের সময় এবং ঋণগ্রস্ত ব্যক্তির কাছে ঋণ তলবের সময় উদারতা প্রদর্শন করে।” -সহীহ বুখারী : ২০৭৬

৮. বেশি বেশি সদকা করা : 

সদকা ব্যবসায়ে বরকত আনে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ব্যবসায়ীদেরকে বেচাকেনার সাথে সাথে সদকার অসিয়ত করেছেন। কায়েস ইবনে আবি গারাযা রা. থেকে বর্ণিত, একদা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের মাঝে আসলেন। আমরা বেচাকেনায় রত ছিলাম। নবীজী বললেন, 

يا معشر التجار، إن الشيطان، والإثم يحضران البيع، فشوبوا بيعكم بالصدقة 

“হে ব্যবসায়ীরা! নিশ্চয় ব্যবসায় শয়তান ও নানান পাপের উপস্থিতি থাকে, অতএব তোমরা তোমাদের বেচাকেনার সাথে সাথে সদকা করো।” -সুনানে তিরমিযি : ১২০৮

পরিশিষ্ঠ : 

ইসলাম মানুষকে সৎ ব্যবসায় উদ্বুদ্ধ করেছে। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নবুওয়াতের পূর্বে নিজেও ব্যবসা করেছেন। সাহাবায়ে কেরামও ব্যবসা করতেন। হযরত আবু বকর রা., হযরত উসমান রা., হযরত আব্দুর রহমান বিন আউফ রা. প্রমুখ সাহাবী প্রসিদ্ধ ব্যবসায়ী ছিলেন। সৎ ব্যবসায়ীর মর্যাদা ও ফজিলত হিসাবে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এই বর্ণনাটিই যথেষ্ঠ,

التاجر الصدوق الأمين مع النبيين، والصديقين، والشهداء

“সত্যবাদী আমানতদার ব্যবসায়ী জান্নাতে নবীগণ, সিদ্দিকগণ এবং শহীদগণের সাথে থাকবে।” -সুনানে তিরমিযি : ১২০৯

তবে জান্নাতে সৎ ব্যবসায়ীর মর্যাদা লাভ করতে হলে অবশ্যই দুনিয়াতে নিজেকে একজন সৎ ব্যবসায়ী হিসাবে গড়ে তুলতে হবে। সৎ ব্যবসায়ীর গুণাবলি নিজের মাঝে ধারণ করতে হবে। আর তার জন্য প্রথম শর্ত হচ্ছে ব্যবসায় হালাল হারামের জ্ঞান অর্জন করা। নৈতিকতার জ্ঞান অর্জন করা।  হযরত ওমর রা. এর ঐতিহাসিক বক্তব্যটি স্মরণ করুন, 

لا يبع في سوقنا إلا من قد تفقه في الدين 

“আমাদের বাজারে ব্যবসা করতে পারবে সেই যে দ্বীন (হালাল হারামের জ্ঞান) শিখেছে।” -সুনানে তিরমিযি : ৪৭৮

তাই প্রত্যেক ব্যবসায়ীর জন্য কর্তব্য হল, ব্যবসা সংক্রান্ত শরীয়াহ জ্ঞান অর্জন করা। হালাল হারাম, জায়েজ নাজায়েজ সম্পর্কে ভালোভাবে জানা এবং তা নিজ ব্যবসায় বাস্তবায়ন করা। অপর ব্যবসায়ী ভাইকেও হালাল ব্যবসায় উদ্বুদ্ধ করা। 

 

লিখেছেন : মুহাম্মদ সানাউল্লাহ

তারিখ : ০৭/১১/২০২৪ ইং

Share:

Facebook
Twitter
Pinterest
LinkedIn
Scroll to Top