Navy Gold Elegant Islamic Group Project Presentation (1)

নন-ফাঞ্জিবল টোকেন (NFTs): সংক্ষিপ্ত অর্থনৈতিক ও শরয়ী বিশ্লেষণ

প্রযুক্তির দ্রুত অগ্রগতির এই সময়ে, ডিজিটাল সম্পদের ধারণা আমাদের দৈনন্দিন জীবন ও অর্থনীতির প্রতিটি স্তরে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করছে। ডিজিটাল সম্পদকে বিভিন্নভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। সহজভাবে বললে, ডিজিটাল সম্পদ হলো, এমন কিছু যা ডিজিটাল পদ্ধতিতে সংরক্ষিত হয় এবং মূল্যবান। (রুসিলি, ২০২৫) এমনই একটি বহুল আলোচিত ও জনপ্রিয় ডিজিটাল সম্পদ হলো নন-ফাঞ্জিবল টোকেন (NFT)। ব্লকচেইনভিত্তিক নন-ফাঞ্জিবল টোকেন বা এনএফটি (NFT) উদ্ভবের মাধ্যমে ডিজিটাল সম্পদের মালিকানায় এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছে। এই প্রযুক্তি বিভিন্ন খাতে অনন্য, অপরিবর্তনযোগ্য ও যাচাইযোগ্য ডিজিটাল প্রতিনিধিত্বের সুযোগ তৈরি করেছে। যদিও এনএফটির জনপ্রিয়তা দিন দিন বাড়ছে, ইসলামি আর্থিক জগতে এটি নিয়ে প্রবল আলোচনা ও বিতর্ক তৈরি হয়েছে—এর নতুনত্ব, অর্থনৈতিক প্রভাব এবং শরিয়তের নীতিমালার সঙ্গে সম্ভাব্য সংঘাতকে কেন্দ্র করে।

এই প্রবন্ধে এনএফটির বিদ্যমান অবস্থা উপস্থাপন করা হয়েছে এবং শরয়ী দৃষ্টিকোণ থেকে এর গভীর বিশ্লেষণ তুলে ধরা হয়েছে। এতে এনএফটির মৌলিক বৈশিষ্ট্য, কার্যক্রমের পদ্ধতি ও অর্থনৈতিক গতিবিধি তুলে ধরা হয়েছে।

NFTs কী?

NFT হলো এক ধরনের ডিজিটাল সম্পদ—যা ইলেকট্রনিকভাবে সংরক্ষিত থাকে এবং যার মধ্যে কিছু মূল্য, মালিকানা কিংবা কোনো নির্দিষ্ট অধিকারের প্রতিনিধিত্ব থাকে, যা ডিজিটালি হস্তান্তরযোগ্য। একটি NFT মূলত একটি অনন্য ডিজিটাল সনদ, যা ব্লকচেইনে সংরক্ষিত থাকে এবং কোনো ডিজিটাল কিংবা বাস্তব সম্পদের মালিকানা প্রমাণ করে (Opensea, 2022)। তবে এর এই ‘অনন্যতা’ সাধারণত NFT-এর মেটাডেটার সঙ্গে সম্পর্কিত হয়, প্রকৃত সম্পদের সঙ্গে নয় (Qin Wang et al., 2021)। তা সত্ত্বেও, এটি ডিজিটাল চিত্রকলা, সঙ্গীত, গেমস, ভার্চুয়াল রিয়েল এস্টেট ও মেধাস্বত্বের মতো বিভিন্ন সম্পদের ওপর একচেটিয়া মালিকানার অধিকার প্রদান করে।

NFT-গুলো ফাঞ্জিবল বা পরিবর্তনযোগ্য সম্পদের মতো নয়—যেগুলো পরস্পর পরিবর্তনযোগ্য ও বিভাজ্য, যেমন টাকার নোট (যা ইসলামি ফিকহে ‘মিছলি’ নামে পরিচিত)। অপরদিকে, ‘নন-ফাঞ্জিবল’ সম্পদ হলো অনন্য, যেগুলোর স্থান অন্য কোনো অনুরূপ বস্তু নিতে পারে না—যেমন একটি নির্দিষ্ট গরু (ফিকহি পরিভাষায় ‘গায়র মিছলি’)। সুতরাং, NFT হলো একটি নন-ফাঞ্জিবল সম্পদ, যার প্রতিটি এককই স্বতন্ত্র এবং একটির পরিবর্তে আরেকটি ব্যবহারযোগ্য নয়। অন্যদিকে, বিটকয়েনের মতো ক্রিপ্টোকারেন্সি ফাঞ্জিবল অর্থাৎ একে অন্যে পরিবর্তনযোগ্য।

NFT-এর কিছু মূল বৈশিষ্ট্য হলো,

– এর অনন্যতা

– অপরিবর্তনযোগ্যতা (যদিও বর্তমানে কিছু ‘ভগ্নাংশে বিভক্ত NFT’ বিদ্যমান)

– ব্লকচেইনের মাধ্যমে স্থানান্তরের সুবিধা

– কৃত্রিম স্বল্পতা বা নির্দিষ্ট সংখ্যায় তৈরি হওয়ার নিশ্চয়তা

– নির্মাতার জন্য পরবর্তী বিক্রয় থেকে স্বয়ংক্রিয় রয়্যালটি পাওয়ার সম্ভাবনা

– স্মার্ট কন্ট্রাক্টের সঙ্গে সংযুক্তির ক্ষমতা ও প্রোগ্রামযোগ্যতা

NFT-এর প্রধান উপাদানগুলোর মধ্যে রয়েছে:

– ব্লকচেইন লেজার

– স্মার্ট কন্ট্রাক্ট

– একটি বিশেষ টোকেন আইডি

– সম্পদ সম্পর্কিত মেটাডেটা

– নিজস্ব ডিজিটাল সম্পদ

– এবং মালিকানা, যা ব্লকচেইন ওয়ালেট ঠিকানার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হয়।

NFT তৈরি ও কেনাবেচার সাধারণ প্রক্রিয়া

প্রথমে একটি ব্লকচেইন নির্বাচন করা হয়, এরপর একটি ক্রিপ্টো ওয়ালেট তৈরি করে তাতে কিছু অর্থ যোগ করতে হয়—যা বিভিন্ন ফি পরিশোধে ব্যবহৃত হয়। এরপর ব্যবহারকারী তার কাঙ্ক্ষিত ডিজিটাল সম্পদ ও তার বর্ণনামূলক তথ্য (মেটাডেটা) আপলোড করে NFT ‘মিন্ট’ করেন, অর্থাৎ NFT হিসেবে তৈরি করেন। এরপর এটি নির্দিষ্ট মূল্য বা নিলামের ভিত্তিতে বিক্রির জন্য তালিকাভুক্ত করা হয়। লেনদেন সম্পন্ন হলে, ক্রেতা NFT পান আর বিক্রেতা পেয়ে থাকেন চুক্তিকৃত ক্রিপ্টোকারেন্সি।

NFT বাজারের বিকাশ ও প্রয়োগ

NFT প্রথমবার আলোচনায় আসে ২০১৪ সালে, তবে ব্যাপকভাবে গ্রহণযোগ্যতা পেতে শুরু করে ২০১৭ সালে, জনপ্রিয় CryptoKitties প্রকল্পের মাধ্যমে। ২০২০ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে NFT বাজারে এক বিস্ফোরক প্রবৃদ্ধি দেখা যায়—যার পেছনে ছিল COVID-19 মহামারি ও OpenSea, Rarible-এর মতো প্ল্যাটফর্মগুলোর প্রসার। ২০২১ সালে এটি সর্বোচ্চ উচ্চতায় পৌঁছায়, যখন Beeple-এর একটি ডিজিটাল শিল্পকর্ম ৬৯ মিলিয়ন ডলারে বিক্রি হয়, এবং NFT বাজারের মোট মূল্য ৪১ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করে। তবে ২০২২ সালে বাজারে মন্দাভাব দেখা দেয় এবং NFT-এর মূল্যে উল্লেখযোগ্য পতন ঘটে।

যদিও লেনদেনের পরিমাণ কমে আসে এবং কিছু প্রধান প্ল্যাটফর্ম তাদের NFT পরিষেবা বন্ধ করে দেয় (Cointelegraph, 2024), ২০২৪ সালে NFT ক্রেতার সংখ্যা বৃদ্ধি পায়—যা বাজারে পুনরুজ্জীবনের ইঙ্গিত দেয়।

NFT-এর প্রচলিত আইটেমগুলোর মধ্যে রয়েছে ডিজিটাল আর্ট (যেমন Beeple-এর “Everydays”, CryptoPunks), গেমিং আইটেম (যেমন Axie Infinity-র চরিত্র বা Decentraland-এর ভার্চুয়াল জমি), সঙ্গীত ও অডিও (যেমন NFT হিসেবে প্রকাশিত অ্যালবাম ও সরাসরি উপার্জনের মডেল), মেটাভার্স প্ল্যাটফর্মে অবস্থিত ভার্চুয়াল রিয়েল এস্টেট, খেলাধুলা সংক্রান্ত স্মারক (যেমন NBA Top Shot-এর হাইলাইটস), এবং অন্যান্য—যেমন ভার্চুয়াল পোশাক বা ইভেন্টের টিকিট।

এনএফটি (NFT)–এর শরয়ী বিশ্লেষণ

এনএফটি হাল জমানায় ইসলামী স্কলারদের মধ্যে গভীর বিতর্কের জন্ম দিয়েছে—শরিয়তের আলোকে এটি বৈধ কি না, তা নিয়ে মতভেদ রয়েছে। কিছু আলেম এনএফটির লেনদেনকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন, আবার কেউ কেউ কঠোর শর্তসাপেক্ষে একে বৈধ বলেছেন। যেহেতু এনএফটি একটি কমোডিটি বা পণ্য, তাই  শরিয়ত অনুযায়ী একটি এনএফটি লেনদেনকে বৈধ হিসেবে গণ্য করতে হলে কোন পণ্য বা কমোডিটি বৈধ হওয়ার যেসব মৌলিক শর্ত রয়েছে, সেগুলো অবশ্যই পূরণ করতে হবে। এই শর্তগুলো হলো:

মালিয়াহ (সম্পদ হিসেবে স্বীকৃতি): এনএফটি-কে সাধারণভাবে কি মূল্যবান সম্পদ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়?

তাকাওউম (শরয়ী বৈধতা): এটি কি শরিয়তের দৃষ্টিতে বৈধ ও কার্যকর কোনো ব্যবহারিক উপকার এনে দেয়?

অস্তিত্ব (উজূদ): লেনদেনের সময় সম্পদটি বাস্তবে বিদ্যমান আছে কি?

মালিকানা (মিলকিয়াহ): বিক্রেতা কি এনএফটির প্রকৃত মালিক? এই মালিকানা কি নিঃশর্ত ও পরিপূর্ণ?

হস্তান্তরযোগ্যতা (কাবিলিয়্যাতুন-নাকল): এনএফটি কি ক্রেতার কাছে বৈধভাবে হস্তান্তরযোগ্য?

স্পষ্ট বিবরণ (ইলম ও বায়ান): এনএফটি কি যথেষ্ট পরিস্কারভাবে সংজ্ঞায়িত ও ব্যাখ্যাযুক্ত?

বিক্রেতার দখল (কব্‌দ): বিক্রেতার কাছে কি সম্পদটির প্রকৃত দখল আছে? যদি তা বাস্তব সম্পদ হয় তবে তা হাকিকী কবদ হতে হবে, আর ডিজিটাল সম্পদের ক্ষেত্রে হুকমী কবদ হলেও চলবে। তবে এনএফটি যদি কোনো বাস্তব সম্পদের কেবল ডিজিটাল সার্টিফিকেট হয় এবং প্রকৃত সম্পদের ওপর নিয়ন্ত্রণ না থাকে, তাহলে এখানে হাকিকী কবদের অভাব শরিয়তের দৃষ্টিতে প্রশ্নবিদ্ধ। অন্যদিকে, ব্লকচেইন প্রযুক্তির মাধ্যমে সংযুক্ত ডিজিটাল সম্পদের ক্ষেত্রে হুকমী কবদ সাধারণভাবে প্রাপ্ত হয়, কেননা সেখানে মালিকানা নিশ্চিতভাবে প্রমাণিত ও সুরক্ষিত থাকে।

ইসরাফ (অপচয়) থেকে বিরত থাকা: এনএফটি কেনা কি অপ্রয়োজনীয় খরচ বা অপচয় হিসেবে গণ্য হয়?

অন্যান্য শরয়ী বিধানের প্রতি আনুগত্য: এই লেনদেন কি শরিয়তের অন্য কোনো মূলনীতি লঙ্ঘন করছে কি না? (ফিকহুল বুয়ু, ১: ২৫৯)

গুরুত্বপূর্ণ শরয়ী উদ্বেগসমূহ

নিম্নোক্ত বিষয়গুলো এনএফটি-কে শরিয়তসম্মত করার পথে বড় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে:

অপচয় বা ইসরাফ: ইসলাম অপ্রয়োজনীয় ও অতিরিক্ত ব্যয় নিষিদ্ধ করে। (আহকামুল কুরআন, ১: ৬৫০, আল জামে লি আহকামিল কুরআন, ১০: ২৪৭) অনেক এনএফটি লেনদেনের বিপুল মূল্য এতোটা অযৌক্তিক যে তা বাস্তব উপকারের তুলনায় অতিরঞ্জিত এবং শরিয়তের চোখে অপচয় হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।

জুয়া (কিমার) ও অনিশ্চয়তা (গারার): কিমার ও গারার শরীয়তের দৃষ্টিতে সুস্পষ্টভাবে নিষেধ। (সূরা মায়েদাহ, আয়াত: ৯০, আহকামুল কুরআন: ১: ৩৯৮, আল মউসুআতুল ফিকহিয়্যাহ আল কুয়েতিয়্যাহ, ৩৯, ৪০৪, নাতায়িজুল বুহুস ওয়া খাওয়াতিমুল কুতুব, ৪: ১২৮)

এনএফটি কেনাবেচার পুরো প্রক্রিয়াটি উচ্চমাত্রার জুয়া ও অনিশ্চয়তার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। ভবিষ্যতের সম্ভাব্য মুনাফার আশায় সম্পদ বিনিয়োগ করা, প্রকৃত ব্যবহারিক উপকারের অভাব এবং দামের চরম ওঠানামা—এসব মিলিয়ে এটি অনেকাংশে জুয়ার বৈশিষ্ট্য বহন করে, যা শরিয়তে নিষিদ্ধ (মাইসির)। এমনকি আংশিক গারার থাকলেও তা নিষিদ্ধ। অনেক সময় এনএফটি ক্রেতারা ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত লাভের আশায় বড় অংকের অর্থ বিনিয়োগ করেন, যার ফলাফল অনিশ্চিত। এমন অনিশ্চয়তা প্ল্যাটফর্মগুলো নিজেরাই স্বীকার করে।

ক্রিপ্টোকারেন্সির ব্যবহার: এনএফটির প্রায় সব লেনদেনে Ether-এর মতো ক্রিপ্টোকারেন্সি ব্যবহৃত হয়। তবে অনেক ইসলামি প্রতিষ্ঠান ক্রিপ্টোকারেন্সিকে শরিয়ত-বিরোধী বলে মনে করে—এর উচ্চ অস্থিরতা, অনুমাননির্ভরতা ও নিজস্ব অন্তর্নিহিত মূল্য (intrinsic value)-এর অনিশ্চয়তা থাকার কারণে। এ কারণে, এনএফটি লেনদেন শরিয়তের দৃষ্টিতে আরও জটিল হয়ে পড়ে। (দারুল ইফতা বানুরী টাউন, ফতোয়া নং: 144307100226)

মালিকানার অস্পষ্টতা ও রয়্যালটির পদ্ধতি: এনএফটি মালিক হলে কেবল একটি ডিজিটাল সার্টিফিকেটের মালিক হওয়া যায়—প্রকৃত কপিরাইট বা বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদের মালিকানা পাওয়া যায় না। ফলে ব্যবহারিক উপকার সীমিত, অধিকাংশ ক্ষেত্রে কেবল পুনর্বিক্রয়ের সম্ভাবনার ওপর নির্ভরশীল।

আবার রয়্যালটির ধারাবাহিকতা—যেখানে নির্মাতা প্রতিবার বিক্রয় থেকে উপকৃত হয়—এটিও শরিয়তের দৃষ্টিতে প্রশ্নবিদ্ধ। কারণ এটি পূর্ণ মালিকানা হস্তান্তরের মূলনীতির পরিপন্থী। তাছাড়া মূল্য নির্ধারণের অস্পষ্টতা (জাহালাহ) ও গারারও বড় চ্যালেঞ্জ।

শরয়ী অভিমতের সারকথা

উপরোক্ত বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে বলা যায়, বর্তমানে এনএফটি শরিয়তসম্মত করার পথে উল্লেখযোগ্য প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। যতদিন না এগুলোর মধ্যে—বৈধ উপকার, অপচয় থেকে মুক্তি, অনুমাননির্ভরতা, জুয়ার উপাদান, প্রকৃত মালিকানা, রয়্যালটি ব্যবস্থা এবং ক্রিপ্টোকারেন্সির শরিয়তসম্মততা—এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে সমাধান না হবে, ততদিন এনএফটি-কে পূর্ণ শরিয়তসম্মত বলা সম্ভব নয়।

এনএফটি-সংক্রান্ত চ্যালেঞ্জ ও ঝুঁকি

অনেক সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও এনএফটি-র সামনে কিছু গুরুতর চ্যালেঞ্জ রয়েছে:

নিয়ন্ত্রণগত অনিশ্চয়তা: এনএফটি ও ক্রিপ্টোকারেন্সি বিষয়ে এখনো স্পষ্ট কোনো আইনগত কাঠামো নেই, যা বিনিয়োগকারীদের ঝুঁকিতে ফেলে এবং বাজারে অংশগ্রহণ নিরুৎসাহিত করে।

বিনিয়োগের অস্থিরতা: এর উচ্চ অনুমাননির্ভরতা ও অপ্রত্যাশিত মূল্য ওঠানামা বিনিয়োগকারীদের জন্য বড় আর্থিক ক্ষতির কারণ হতে পারে, বিশেষত যারা অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল।

প্রযুক্তিগত ও জ্ঞানগত সীমাবদ্ধতা: ডিজিটাল শিক্ষার অভাব, দুর্বল ইন্টারনেট, সাইবার নিরাপত্তা এবং প্রযুক্তিগত পরিকাঠামোর দুর্বলতা এর ব্যাপক প্রসারে অন্তরায়।

কর ও আইনগত জটিলতা: কর কাঠামো এখনো অনির্ধারিত এবং আইনি স্বীকৃতি অস্পষ্ট হওয়ায় লেনদেনে জটিলতা ও অনিশ্চয়তা তৈরি হয়।

প্রতারণা ও অর্থপাচারের ঝুঁকি: পর্যাপ্ত নজরদারি না থাকায় ‘রাগ পুল’ (হঠাৎ উধাও হয়ে যাওয়া প্রকল্প) এবং আর্থিক অপরাধের ঝুঁকি অনেক বেশি।

শরিয়তসম্মততার অভাব: মুসলিম বিনিয়োগকারীদের জন্য এটি একটি অতিরিক্ত প্রতিবন্ধকতা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।

ইসলামি সামাজিক অর্থব্যবস্থায় এনএফটি (NFT)-এর সম্ভাব্য ব্যবহার

এনএফটি ইসলামি সামাজিক অর্থব্যবস্থায় নতুন দিগন্ত উন্মোচনের সম্ভাবনা রাখে—বিশেষ করে ওয়াক্‌ফ (স্থায়ী দান) ও জাকাত খাতে।

ওয়াক্‌ফ: ব্লকচেইনভিত্তিক NFT ব্যবহারের মাধ্যমে ওয়াক্‌ফ সম্পদ ডিজিটালি নিবন্ধন করা সম্ভব, যা স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে সাহায্য করবে। এ পদ্ধতিতে মালিকানা, ব্যবহার ও লেনদেনের তথ্য নির্ভরযোগ্যভাবে সংরক্ষিত থাকবে। ডিজিটাল সম্পদকে ওয়াক্‌ফ ঘোষণার মাধ্যমে তা সমাজসেবামূলক কাজে ব্যয় করা যাবে, আর NFT ইস্যুর মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহের একটি আধুনিক, স্বচ্ছ ও প্রযুক্তিনির্ভর মাধ্যম তৈরি হবে—যা দাতাদের আস্থা আরও বৃদ্ধি করবে। স্মার্ট কন্ট্রাক্ট ব্যবহারের মাধ্যমে ওয়াক্‌ফ আয়ের স্বয়ংক্রিয় বিতরণও সম্ভব হতে পারে।

যাকাত: যেসব NFT বাণিকজ্যিক উদ্দেশ্যে ক্রয় করা হয়, সেগুলো ব্যবসায়িক সম্পদ হিসেবে যাকাতযোগ্য। তবে এগুলোর যাকাতযোগ্য মূল্য নির্ধারণ করা জটিল, কারণ এদের দাম খুবই অস্থির ও পরিবর্তনশীল। বাস্তবসম্মত সমাধান হিসেবে এনএফটি ইস্যুর প্রাথমিক মূল্যকে ভিত্তি ধরার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। তবে ব্যক্তিগত আনন্দ বা সংগ্রহের উদ্দেশ্যে কেনা NFT-তে যাকাত ফরজ হয় না।

তবে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো—যেহেতু এনএফটি প্রকৃতপক্ষে এক ধরনের অনুমাননির্ভর, অনির্ধারিত মূল্যের সম্পদ এবং ইসলামি শরিয়ত যাকাত পরিশোধের জন্য স্থিতিশীল ও ব্যাপকভাবে স্বীকৃত সম্পদ ব্যবহারের নির্দেশ দেয়, তাই এনএফটি-কে সরাসরি যাকাত পরিশোধের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা শরিয়তসম্মত নয়।

সুপারিশসমূহ

NFT-কে ইতিবাচক ও নৈতিকভাবে সমাজে অন্তর্ভুক্ত করতে হলে নীতিনির্ধারকদের জন্য নিচের সুপারিশগুলো বিবেচনায় নেওয়া প্রয়োজন—

নিয়ন্ত্রক কাঠামো গঠন:

NFT-এর মালিকানা, করব্যবস্থা ও অর্থপাচার প্রতিরোধ—এই সব বিষয়ের জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ ও সুসংগঠিত আইনগত কাঠামো তৈরি করতে হবে। এর মাধ্যমে বাজারে স্থিতিশীলতা বজায় থাকবে এবং সাধারণ ব্যবহারকারীরা সুরক্ষা পাবে।

সাধারণ শিক্ষার প্রসার ও ডিজিটাল সাক্ষরতা:

NFT ও ব্লকচেইন প্রযুক্তি, এর ঝুঁকি ও সম্ভাবনা নিয়ে জনসচেতনতা তৈরির উদ্যোগ নিতে হবে, যাতে মানুষ সচেতনভাবে এবং নিজ সিদ্ধান্তে প্রযুক্তিতে অংশগ্রহণ করতে পারে।

নৈতিক ও শরিয়তসম্মত কাঠামো গঠন:

NFT লেনদেনকে শরিয়তসম্মত করতে হলে স্পষ্ট নির্দেশনা প্রয়োজন, যেখানে বৈধ ও উপকারী সম্পদের ওপর ভিত্তি করে লেনদেন হবে, জুয়া ও অপচয়ের প্রবণতা থাকবে না, এবং স্বচ্ছতা বজায় থাকবে। শরিয়াহ পর্যালোচনা বোর্ড দ্বারা তত্ত্বাবধান নিশ্চিত করতে হবে। এর বাস্তব উদাহরণ হতে পারে ইসলামি চিত্রকলা ও সংস্কৃতি বিষয়ক NFT-এর জন্য শরিয়তসম্মত একটি মার্কেটপ্লেস গড়ে তোলা।

উপসংহার

NFT প্রযুক্তি নতুন দিগন্তের দুয়ার খুলে দিয়েছে—নিরাপদ লেনদেন, নতুন আয়ের পথ ও উদ্ভাবনী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা তৈরির সুযোগ এনেছে। তবে এর পাশাপাশি রয়েছে দামের অস্থিরতা, জুয়া-সদৃশ অনুমাননির্ভরতা ও আইনগত অনিশ্চয়তার মতো গুরুতর চ্যালেঞ্জ, যা বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে অবকাঠামোগত দুর্বলতা ও ডিজিটাল অজ্ঞতার কারণে আরও তীব্র হয়ে ওঠে।

শরিয়তের দৃষ্টিকোণ থেকে এনএফটির ক্ষেত্রে জুয়ার উপাদান, মালিকানার অস্পষ্টতা ও রয়্যালটির বিতর্কিত গঠন পদ্ধতি বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। তবুও ওয়াক্‌ফ ও যাকাতের মতো খাতে এর ইতিবাচক ব্যবহারিক সম্ভাবনা আছে, যা সমাজকল্যাণে অবদান রাখতে পারে।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে NFT ব্যবস্থাকে সফলভাবে কাজে লাগাতে হলে প্রয়োজন—একটি ভারসাম্যপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি, কার্যকর নীতিমালা, জনশিক্ষা এবং শরিয়তসম্মত ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম। এর মাধ্যমেই NFT প্রযুক্তিকে নৈতিক ও টেকসই উন্নয়নের পথে পরিচালিত করা সম্ভব হবে।

রেফারেন্স

Adam F, (2021) NFT Shariah Compliant. Amanah Advisory

Cointelegraph. (2023). Crypto phishing scams took almost $300M from 324K victims in 2023: Report. https://cointelegraph.com (Retrieved February 15, 2025)

Rosele, M. I., Muneem, A., Ali, A. K., & Che Seman, A. (2025). A proposed zakat model for digital assets from the Shariah perspective. International Journal of Islamic and Middle Eastern Finance and Management.

Taqi Usmani, M. (n.d.). Fiqh al-Buyu’. Ma’ariful Qur’an.

Opensea (2022). What is an NFT? https://opensea.io/learn/nft/what-are-nfts (Retrieved August 26, 2022)

Wang, Q., Li, R., Wang, Q., & Chen, S. (2021). Non-fungible token (NFT): Overview, evaluation, opportunities and challenges. SSRN Electronic Journal.

লিখেছেন-
মাওলানা আরিফুল ইসলাম
রিসার্চার, আদল অ্যাডভাইজরি

Share:

Facebook
Twitter
Pinterest
LinkedIn
Scroll to Top