জীবনের প্রতিটি সময়ই মূল্যবান। যে সফলতা অর্জন করতে চায় তাকে সময়ের মূল্য দিতে হয়। তা পার্থিব জীবন ও আখেরাত উভয় ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। কিন্তু এই মূল্যবান সময়ের মধ্যেও আল্লাহ তাআলা মুমিনের গুনাহ মাফ ও অপার নেকী অর্জনের জন্য কিছু দিবস ও রজনীকে নির্বাচন করেছেন। এর মধ্যে অন্যতম হল, জিলহজ্ব মাসের প্রথম ১০ দিন ও আইয়্যামে তাশরীকের দিনগুলো। তথা জিলহজ্ব মাসের প্রথম ১৩ দিন। জিলহজ্ব মাসের প্রথম দশকের ফজিলত সম্পর্কে আল্লাহ তাআ’লা এরশাদ করেন, وَٱلۡفَجۡرِۙ ١ وَلَيَالٍ عَشۡرٍۙ ٢ “শপথ ফজরের এবং শপথ দশ রাতের।” (সূরা আল-ফাজর: ১-২)।
তাফসীর: এই “দশ রাত” দ্বারা জিলহজ্ব মাসের প্রথম দশ রাতকে বোঝানো হয়েছে। এটি আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস, ইবনুয-যুবায়ের, মুজাহিদ এবং অন্যান্য মুফাসসিরদের মত।” (তাফসীর ইবন কাসীর, সূরা আল-ফাজর: ২)
পবিত্র কুরআনের ভাষায় জিলহজ্ব মাস সম্মানিত মাসসমূহের অন্যতম (সূরা তাওবা, আয়াত: ৩৬)। এ মাসটি অত্যন্ত মহিমান্বিত, কারণ এর সাথে জড়িয়ে আছে ইসলামের বহু করুণ ও মহান ত্যাগের ইতিহাস। এটি সেই মাস, যখন হযরত ইব্রাহীম (আলাইহিস সালাম) তাঁর প্রিয় পুত্র ইসমাইল (আলাইহিস সালাম)-কে আল্লাহর রাস্তায় কুরবানীর জন্য প্রস্তুত করেছিলেন, যা আমাদের মাঝে ত্যাগ ও আত্মোৎসর্গের চেতনা জাগিয়ে তোলে। এই পবিত্র মাসেই বিবি হাজেরা (আলাইহাস সালাম) অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। যখন তিনি তাঁর নবজাতক পুত্র ইসমাইল (আলাইহিস সালাম)-কে কাবা শরিফের পাশে রেখে আল্লাহর উপর পূর্ণ তাওয়াক্কুল করে সাহসিকতার সাথে পানি অন্বেষণে সাফা ও মারওয়ার মাঝে ছুটোছুটি করেছিলেন। তাঁর এই অবিচল ধৈর্য, ঈমান এবং তাওয়াক্কুল আজও আমাদের জন্য অনুপ্রেরণার বাতিঘর।
জিলহজ মাসের এই গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাস আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়—আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য জান-মালের কুরবানী করা, ত্যাগ স্বীকারের মনোভাব অর্জন করা, এবং ইবাদতে একাগ্রতা বৃদ্ধি করা। পাশাপশি হজ্বের সফর জীবনের পাপরাশিকে ধুয়ে মুছে শুভ্র সফেদের ন্যায় পবিত্র করে দেয় এবং মুসলিম উম্মাহকে জাগিয়ে তোলে ঈমানি চেতনায় ।
এই বরকতময় জিলহজ্ব মাসের কিছু গুরুত্বপূর্ণ আমলঃ
১. জিলহজ্বের চাঁদ দেখার পর থেকে কুরবানী করার আগ পর্যন্ত- স্বীয় নখ ও চুল না কাটা। এটি মুস্তাহাবঃ
إِذَا رَأَيْتُمْ هِلَالَ ذِي الْحِجَّةِ، وَأَرَادَ أَحَدُكُمْ أَنْ يُضَحِّيَ، فَلْيُمْسِكْ عَنْ شَعْرِهِ وَأَظْفَارِهِ
“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, যখন তোমরা জিলহজের চাঁদ দেখবে এবং কেউ কুরবানীর ইচ্ছা করবে, সে যেন চুল এবং নখ কাটা থেকে বিরত থাকে।” (সহীহ মুসলিম: ১৯৭৭)
২. জিলহজ্বের প্রথম দশকে নফল রোযা রাখাঃ
عن هُنَيْدَةَ بْنِ خَالِدٍ، عَنْ امْرَأَتِهِ، عَنْ بَعْضِ أَزْوَاجِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم قَالَتْ: كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم يَصُومُ تِسْعَ ذِي الْحِجَّةِ، وَيَوْمَ عَاشُورَاءَ، وَثَلاَثَةَ أَيَّامٍ مِنْ كُلِّ شَهْرٍ.
“উম্মুল মুমিনীনদের একজন হতে বর্ণিত, তিনি বলেছেন: রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জিলহজের প্রথম নয় দিন, আশুরার দিন এবং প্রতিমাসের তিন দিন রোযা রাখতেন।” (মুসনাদ আহমদ: ২১৮৬, আবু দাউদ: ২৪২৯, নাসাঈ: ২৪১৬)
৩. বিশেষত আরাফার দিনের রোযা (৯ জিলহজ) রাখাঃ
صِيَامُ يَوْمِ عَرَفَةَ أَحْتَسِبُ عَلَى اللَّهِ أَنْ يُكَفِّرَ السَّنَةَ الَّتِي قَبْلَهُ وَالسَّنَةَ الَّتِي بَعْدَهُ
“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, আরাফার দিনের রোযা (৯ জিলহজ) বিগত এক বছরের এবং আগামী এক বছরের গুনাহের কাফফারা হিসেবে আশা করা যায়।” (সহীহ মুসলিম: ১১৬২)
৪. ৯ জিলহজ ফজর থেকে ১৩ জিলহজ আসর পর্যন্ত নারী-পুরুষ, মুসাফির সকলের জন্য প্রত্যেক ফরজ নামাজের পর তাকবীরে তাশরীক বলা ওয়াজিব। আল্লাহ তাআ’লা এরশাদ করেনঃ
واذكروا الله في أيام معدودات
“নির্দিষ্ট দিনগুলোতে আল্লাহর বড়ত্ব ঘোষণা করো।” (সূরা বাকারা, আয়াত: ২০৩)
তাকবীরে তাশরীক:
اللَّهُ أَكْبَرُ، اللَّهُ أَكْبَرُ، لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ، وَاللَّهُ أَكْبَرُ، اللَّهُ أَكْبَرُ، وَلِلَّهِ الْحَمْدُ
(আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার ওয়া লিল্লাহিল হামদ)
তাফসীর: হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বলেন, “নির্দিষ্ট দিনসমূহ” হল, আইয়্যামুত তাশরীক তথা: জিলহজের ১১, ১২ ও ১৩ তারিখ। (তাফসীরে ইবনে কাসীর: সূরা বাকারা, আয়াত ২০৩)
৫. ঈদের রাতের ইবাদতের ফজিলত অর্জনের চেষ্টা করা।
من أحيا ليلة العيدين لله، لم يمت قلبه يوم تموت القلوب
“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য দুই ঈদের রাত জাগরণ করে, তার অন্তর সেই দিন মৃত হবে না যেদিন অন্যদের অন্তর মৃত হবে।” (ইবন মাজাহ: ১৭৮২)
আসুন, আমরা এই মাসের বরকতপূর্ণ সময়কে যথাসম্ভব ইবাদত ও ভালো কাজে ব্যয় করি, এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের চেষ্টা করি।
লিখেছেন: মুফতী আহসানুল ইসলাম, CSAA
তারিখ: ২৮/০৫/২০২৫ ইং