কুরবানী ইসলামের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত ইবাদত। যা ‘শেয়ারে ইসলাম’ এর অন্তর্ভুক্ত। এটি মুসলিম উম্মাহর জন্য আত্মত্যাগ, তাওহীদের ঘোষণা এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের এক মহান অনুশীলন। কুরবানী শব্দটি আরবি “قُرْبٌ” (কুরবুন) মূলধাতু থেকে উদ্ভূত, যার অর্থ নৈকট্য বা সান্নিধ্য। অর্থাৎ, কুরবানীর প্রকৃত উদ্দেশ্য হলো আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করা এবং তাঁর সন্তুষ্টির জন্য জান-মাল উৎসর্গ করা। পবিত্র কুরআনুল কারীমে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,
قُلْ إِنَّ صَلَاتِي وَنُسُكِي وَمَحْيَايَ وَمَمَاتِي لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ
অর্থ : বলুন, আমার সালাত, আমার কুরবানী, আমার জীবন, আমার মরণ জগতসমূহের প্রতিপালক আল্লাহ তাআলার জন্য। (সূরা আনআম : ১৬২)
কুরবানী সমাগত। বিশ্ব মুসলিম কুরবানীর প্রস্তুতি নিচ্ছে। এই প্রস্তুতির অন্যতম অনুষঙ্গ হল, কুরবানীর মাসায়েল সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করা। যার ব্যাপ্তি কুরবানীর পশু ক্রয় করা থেকে নিয়ে যবেহ ও যবেহ পরবর্তী কার্যক্রম পর্যন্ত বিস্তৃত। কুরবানী সুষ্ঠু ও সঠিকভাবে করার জন্য এর সাথে সংশ্লিষ্ট মাসায়েল জানার বিকল্প নেই। এই উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে মারকাযু দিরাসাতিল ইকতিসাদিল ইসলামী বক্ষ্যমাণ প্রবন্ধটি প্রস্তুত করেছে। এতে কুরবানীর পশু ক্রয়-বিক্রয় সংক্রান্ত অতিপ্রয়োজনীয় কিছু মাসআলা সন্নিবেশিত হয়েছে। বিশেষত বর্তমান সময়ে কুরবানির পশু ক্রয়-বিক্রয়ের একটি জনপ্রিয় মাধ্যম ‘খামার থেকে পশু ক্রয়’ করার বিষয়ে বিশদভাবে আলোচনা করা হয়েছে। আল্লাহ রব্বুল আলামিন আমাদের সকল নেক আমলকে একমাত্র তাঁর সন্তুষ্টির জন্য কবুল করুন।
কুরবানীর পশুর বৈশিষ্ট্য
যে পশু দ্বারা কুরবানী করা জায়েজ :
চার শ্রেণীর গৃহপালিত পশু দ্বারা কুরবানী করা জায়েজ। যথা :
১. উট। কমপক্ষে ৫ বছর বয়সের হতে হবে।
২. গরু, মহিষ। কমপক্ষে ২ বছর বয়সের হতে হবে।
৩. ছাগল (নর, মাদা ও খাসি)। কমপক্ষে ১ বছর বয়সের হতে হবে।
৪. ভেড়া ও দুম্বা। কমপক্ষে ১ বছর বয়সের হতে হবে। তবে ভেড়া ও দুম্বার ক্ষেত্রে ৭ মাস হলেও যথেষ্ট হবে, যদি তা এমন হৃষ্টপুষ্ট হয় যে দেখতে ১ বছরের সমান মনে হয়। [ফাতাওয়া হিন্দিয়া, খণ্ড ৫, পৃষ্ঠা ৩৪৩, খুলাসাতুল ফাতাওয়া, খণ্ড ৪, পৃষ্ঠা ৩১৩]
সংশ্লিষ্ট মাসআলা : কুরবানীর পশুর বয়স নির্ণয়ের ক্ষেত্রে যদি বিক্রেতা বয়স হয়েছে বলে জানায় এবং পশুর শারীরিক অবস্থা ও অন্যান্য আলামত দেখে তেমনটাই মনে হয়, তাহলে বিক্রেতার কথার উপর নির্ভর করে পশু ক্রয় করা ও তার দ্বারা কুরবানী করা বৈধ আছে। তবে এক্ষেত্রে বিক্রেতার অভিজ্ঞতা ও বিশ্বস্ততার বিষয়টি লক্ষ করা উচিত। [আহকামে ঈদুল আজহা, পৃষ্ঠা ৫, আহসানুল ফাতাওয়া, খণ্ড ৭, পৃষ্ঠা ৪৭৭]
যে পশু দ্বারা কুরবানী করা জায়েজ নেই :
১. উপরোক্ত ৪ শ্রেণীর পশু ছাড়া অন্য কোন পশু যেমন হাস, মুরগি, কবুতর, পাখি ইত্যাদি দ্বারা কুরবানী করা জায়েজ নয়। [খুলাসাতুল ফাতাওয়া, খণ্ড ৪, পৃষ্ঠা ৩১৩]
২. রুগ্ন ও দুর্বল পশু : এমন রুগ্ন ও দুর্বল পশু দ্বারা কুরবানী করা জায়েজ নয়, যা নিজে নিজে জবাইয়ের স্থান পর্যন্ত হেঁটে যেতে পারে না। [আদ্দুরুল মুখতার, খণ্ড ৬, পৃষ্ঠা ৩২৩]
৩. খোড়া পশু : খোড়া বা ল্যাংড়া পশু, যা তার এক বা একাধিক পায়ে একেবারেই ভর দিতে পারে না, তা দ্বারা কুরবানী করা জায়েজ নয়। [আল বাহরুর রায়েক, খণ্ড ৮, পৃষ্ঠা ৩২৩]
৪. শিং ভাঙ্গা পশু : যে পশুর শিং একেবারে গোড়া থেকে ভেঙ্গে গেছে, যে কারণে তার মস্তিষ্ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তা দ্বারা কুরবানী করা জায়েজ নয়। তবে যদি আংশিক ভাঙ্গে বা শিং না-ই উঠে, তাহলে কোন সমস্যা নেই। [খুলাসাতুল ফাতাওয়া, খণ্ড ৪, পৃষ্ঠা ৩২০]
৫. কান বা লেজ কাটা পশু : যে পশুর কান বা লেজ অর্ধেক অথবা তার চেয়ে বেশি কাটা, তা দ্বারা কুরবানী করা জায়েজ নয়। [খুলাসাতুল ফাতাওয়া, খণ্ড ৪, পৃষ্ঠা ৩২১]
৬. দন্তবিহীন পশু : যে পশুর একটি দাতও নেই অথবা এত বেশি দাত পড়ে গেছে যে, ঘাস বা খাদ্য চিবাতে পারে না এমন পশু দ্বারা কুরবানী করা জায়েজ নয়। [আল মুহিতুল বুরহানী, খণ্ড ৮, পৃষ্ঠা ৪৬৬]
৭. অন্ধ পশু : যে পশুর উভয় চোখ কিংবা কোন একটি চোখ অন্ধ তা দ্বারা কুরবানী করা জায়েজ নয়। [আল মুহিতুল বুরহানী, খণ্ড ৮, পৃষ্ঠা ৪৬৬]
কুরবানীর পশু ক্রয়ের ক্ষেত্রে উপরোক্ত বৈশিষ্ট্যাবলী লক্ষ্য রাখা বাঞ্ছনীয়। অন্যথায় কুরবানী শুদ্ধ হবে না।
কুরবানীর পশু ক্রয়-বিক্রয়ের ক্ষেত্রে ক্রেতা বিক্রেতার করণীয়
কুরবানী একটি ইবাদাত। এর সাথে সম্পৃক্ত প্রত্যেকটি কাজই ইবাদত। তাই কুরবানীর পশুর ক্রেতা বিক্রেতা ও সংশ্লিষ্ট সকলের উচিত পরিপূর্ণ শরীয়াহ মেনে ক্রয় বিক্রয় করা। ক্রয় বিক্রয়ের প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে সাওয়াবের আশা রাখা। অপরকে ধোঁকা না দেয়া, কোন ধরনের অন্যায় আচরণ না করা। নিম্নে কুরবানীর পশুর ক্রেতা বিক্রেতা উভয়ের কিছু করণীয় উল্লেখ করা হল :
বিক্রেতার করণীয় :
১. সততা ও আমানতদারিতা রক্ষা করা : যে কোন ব্যবসায়ই সততা ও আমানতদারিতার গুরুত্ব অপরিসীম। হাদীসে এসেছে,
التاجر الصدوق الأمين مع النبيين، والصديقين، والشهداء.
“সত্যবাদী আমানতদার ব্যবসায়ী জান্নাতে নবীগণ, সিদ্দিকগণ এবং শহীদদের সাথে থাকবে।” [সুনানে তিরমিযি, হাদীস নং ১২০৯]
তাই কুরবানীর পশু বিক্রয়ের ক্ষেত্রে সততা ও আমানতদারিতা প্রতি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া উচিত। পশুর বয়স বলার ক্ষেত্রে আমানতদারিতা রক্ষা করা, পশুর গুণাগুণ, বৈশিষ্ট বর্ণনায় সততা বজায় রাখা। অতিরঞ্জিত না করা।
২. মিথ্যা কসম না খাওয়া : মিথ্যা কসম ব্যবসার বরকতকে নষ্ট করে দেয়। হাদীসে এসেছে,
إياكم وكثرة الحلف في البيع، فإنه ينفق، ثم يمحق.
“তোমরা বেচাকেনায় অত্যধিক কসম করা থেকে বিরত থাক, কেননা তা পণ্যকে বাজারে অচল করে দেয় আর ব্যবসার বরকত নষ্ট করে দেয়।” [সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১৬০৭]
৩. ‘নাজাশ’ তথা দালালি এবং ধোঁকা ও প্রতারণা থেকে বিরত থাকা : কুরবানীর পশু ক্রয়ের ক্ষেত্রে ক্রেতারা নানানভাবে ধোঁকার শিকার হন। মিথ্যা, প্রতারণা ও দালালি যেন কুরবানীর হাটের আবশ্যক অংশ। হাদীসে এ ব্যাপারে ধমকি এবং নিষেধাজ্ঞা এসেছে।
عن ابن عمر رضي الله عنهما قال نهى النبي صلى الله عليه وسلم عن النجش
“হযরত ইবনে উমর রা. বলেন, নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ‘নাজাশ’ (তথা ধোঁকা ও প্রতারণামূলক দালালি) থেকে নিষেধ করেছেন। [সহীহ বুখারী, হাদীস নং ২১৪২]
নবীজী আরো বলেছেন, “যে মানুষকে ধোঁকা দেয়, সে আমার দলভুক্ত নয়।” [সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১৬৪]
ক্রেতার করণীয় :
১. নিয়ত পরিশুদ্ধ করা : কুরবানী শুদ্ধ হওয়ার জন্য ক্রয়ের সময়ই নিয়ত পরিশুদ্ধ করা আবশ্যক। একমাত্র আল্লাহর জন্যই কুরবানী করার উদ্দেশ্যে পশু ক্রয় করবে, গোশত খাওয়ার জন্য নয়। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,
لَن يَنَالَ ٱللَّهَ لُحُومُهَا وَلَا دِمَآؤُهَا وَلَٰكِن يَنَالُهُ ٱلتَّقْوَىٰ مِنكُمْ
“আল্লাহ তাআলার কাছে কুরবানীর পশুর গোশত পৌঁছে না, রক্তও পৌঁছে না। বরং তার কাছে পৌঁছে কেবল তোমাদের তাকওয়া।” [সূরা হজ্ব, আয়াত নং ৩৭]
২. বিক্রেতার প্রতি মহানুভব হওয়া : যে কোন ক্রয়-বিক্রয়ে ক্রেতা বিক্রেতা একে অপরের প্রতি উদার ও মহানুভব হওয়া উচিত। কেউ কাউকে ঠকাবে না, ক্ষতিগ্রস্ত করবে না। কুরবানীর পশু ক্রয়ের ক্ষেত্রে এই বিষয়টির প্রতি আরো বেশি গুরুত্ব দিতে হবে।
কুরবানীর হাটে কখনো চাহিদার চেয়ে অধিক পশু থাকলে বিক্রেতাকে ঠেকা ও অনন্যোপায় পেয়ে ন্যায্য মূল্যের চেয়ে কম না দেয়া। নৈতিকভাবে এটি অন্যায়। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ক্রয়-বিক্রয়ে মহানুভবতার জন্য রহমতের দোয়া করেছেন। হাদীসে এসেছে,
رحم الله رجلا سمحا، إذا باع، وإذا اشترى، وإذا اقتضى.
“আল্লাহ তাআলা ঐ ব্যক্তির প্রতি রহম করুন, যে ক্রয়-বিক্রয়ের সময় এবং পাওনা আদায়ের সময় উদারতা প্রদর্শন করে।” [সহীহ বুখারী, হাদীস নং ২০৭৬]
৩. বিক্রয়ের সাথে সম্পৃক্ত অন্যান্যদের হকের ব্যাপারে সতর্ক থাকা : কুরবানীর পশু ক্রয়ের ক্ষেত্রে বিক্রেতা ছাড়াও বিক্রয়ের সাথে সম্পৃক্ত অন্যান্য যে সকল হক আছে, সেগুলোর ব্যাপারেও সতর্ক থাকতে হবে। যেমন, হাসিল। এটি হাট কর্তৃপক্ষের হক। যা হাটের সুবিধা গ্রহণের বিনিময়ে নেওয়া হয়। তাই এ টাকা পরিশোধ করা জরুরি। হাসিল না দিলে হাট কর্তৃপক্ষের হক নষ্ট করার গুনাহ হবে।
সংশ্লিষ্ট মাসআলা : হাসিল না দিলে কুরবানী হবে কি?
হাসিল হাটের ভাড়া। এটি হাট কর্তৃপক্ষের হক। না দিলে হাট কর্তৃপক্ষের হক নষ্ট করার গুনাহ হবে। তবে কুরবানী হয়ে যাবে। কুরবানী শুদ্ধ হওয়ার সাথে এর কোন সম্পর্ক নেই। [ফাতাওয়া বান্নুরী টাউন, ফতোয়া নং ১৪৪১১১২০১৬৯৭]
খামার থেকে পশু ক্রয়-বিক্রয়
বর্তমান সময়ে খামার থেকে কুরবানির পশু ক্রয় করার বিষয়টি বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। যা মানুষের জন্য কুরবানির পশু ক্রয়-বিক্রয় সহজ করে দিয়েছে। তবে চুক্তির শরীয়াহ অবকাঠামোর দিক থেকে সাধারণ বাজার থেকে পশু ক্রয়-বিক্রয়ের তুলনায় এতে কিছু ভিন্নতা আছে। যা অনেকেরই অজানা। একজন মুসলিম হিসাবে যেকোন লেনদেনে জড়ানোর পূর্বে তার শরীয়াহ বিধানাবলি জানা ও অনুসরণ করা আমাদের কর্তব্য।
শরীয়াহ বিষয়ক আলোচনার পূর্বে খামার থেকে পশু ক্রয় বিক্রয়ের প্রচলিত পদ্ধতি সম্পর্কে কিছু ধারণা নেয়া যাক।
খামার থেকে পশু ক্রয়ের প্রচলিত পদ্ধতি
আমরা আমাদের সাধ্যমত কুরবানির পশু বিক্রয়ের বিভিন্ন ওয়েবসাইট, খামারের মালিক এবং যারা এই কাজের সাথে সরাসরি জড়িত, তাদের সাথে আলোচনা করে বর্তমানে পশু ক্রয় বিক্রয়ের প্রচলিত যে সকল পদ্ধতি সম্পর্কে অবগত হতে পেরেছি তা নিম্নরূপ :
- গ্রাহক বা ক্রেতা অনলাইনে বা অফলাইনে সরাসরি গিয়ে গরু দেখে, গরুর বয়স, ওজন ও অন্যান্য তথ্য জেনে পছন্দ হলে সম্ভাব্য মূল্যের ২০, ২৫ বা ৩০% মূল্য ‘বুকিং মানি’ হিসাবে অগ্রিম দিয়ে কুরবানীর পশু বুকিং দেয়।
- বুকিং দেয়ার সময় পশুর সেই সময়ের ওজন অনুযায়ী সম্ভাব্য মূল্য ধরে তার নির্ধারিত পার্সেন্ট বুকিং মানি প্রদান করতে হয়। এ সময় পশুর চূড়ান্ত মূল্য নির্ধারণ হয় না। চূড়ান্ত মূল্য নির্ধারণ হয় কুরবানীর ১/২ দিন পূর্বে যখন পশু গ্রাহকের ঠিকানায় ডেলিভারি করার সময় হয়।
- বুকিং দেওয়ার পর সাধারণত গরু খামারেই রাখা হয়। (তবে ঈদের কাছাকাছি সময় হলে ভিন্ন কথা। সেক্ষেত্রে কখনো কখনো নগদ পূর্ণ মূল্য দিয়ে গরু কিনে নিয়ে আসা হয়)।
- এ সময় গরুর যাবতীয় ঝুঁকি খামার কতৃপক্ষের থাকে। খাবার ও অন্যান্য খরচ অধিকাংশ ক্ষেত্রে খামার বহন করে। কোন কোন খামারে ক্রেতা থেকেও নির্দিষ্ট পরিমাণ চার্জ নিয়ে থাকে।
- এরপর গ্রাহকের চাহিদা অনুযায়ী ঈদের ১/২ দিন পূর্বে পশুকে পুনরায় ওজন দিয়ে চূড়ান্ত মূল্য নির্ধারণ করত চুক্তি সম্পন্ন করা হয়। বুকিং মানি মূল্যের মাঝে অন্তর্ভুক্ত করে গ্রাহক থেকে বাকি মূল্য বুঝে নিয়ে গরু ডেলিভারি করা হয়।
- ডেলিভারি চার্জ সাধারণত খামার কর্তৃপক্ষ বহন করে। এক্ষেত্রে মূলত মূল্য নির্ধারণই এমনভাবে করা হয়, যাতে ডেলিভারি চার্জ ও অন্যান্য খরচ অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়।
- কোন কোন গ্রাহক বা ক্রেতা জীবিত পশু না নিয়ে খামারেই কুরবানী করে গোশত প্রসেসিং করে নিতে আগ্রহী থাকে। তাদের সাথে লেনদেনের ক্ষেত্রে প্রসেসিং কস্ট যুক্ত করে মূল্য নির্ধারণ করা হয়।
শরীয়াহ নির্দেশনা
এই নির্দেশনাটি খামার কর্তৃপক্ষ এবং খামার থেকে যারা পশু ক্রয় করবে উভয় পক্ষের জন্য প্রযোজ্য।
বুকিং মানির বিধান ও চুক্তির Point of time নির্ণয় :
আমরা পূর্বে যে বিষয়টি দেখেছি যে, প্রায় সকল খামারেই পশু ক্রয়ের জন্য শুরুতে বুকিং মানি দিতে হয় এবং আরো দেখেছি যে, বুকিং মানি দেয়ার পর কুরবানীর আগ পর্যন্ত পশুটি খামারে রাখা হয় এবং তার যাবতীয় খরচ ও ঝুঁকি খামার কর্তৃপক্ষ বহন করে। উক্ত প্র্যাক্টিস এবং বাস্তবতা এই বিষয়টিকে নির্দেশ করে যে, বুকিং মানি দেয়ার সময়টি আসলে চুক্তির Point of time না। অর্থাৎ এসময় ক্রয় চুক্তি চূড়ান্ত হচ্ছে না।
এ বিষয়টি আমরা খামারীদের সাথেও আলোচনা করেছি, কোন কোন খামারী এই বিষয়টি স্বীকার করেছেন যে চুক্তিটি সম্পন্ন হয় মূলত পশু ডেলিভারি দেয়ার সময়। এর উপর ভিত্তি করে আমরা এ কথা বলতে পারি যে, বুকিং মানি মূলত মূল বেচাকেনার পূর্বে প্রদত্ত টাকা, যা পরবর্তীতে বেচাকেনা চূড়ান্ত হওয়ার সময় মূল্যের অংশ হিসাবে গণ্য হবে।
অতএব, বুকিং মানির শরীয়াহ বিধান হল :
- বুকিং মানি প্রদান করা ও ক্রয়ের ব্যাপারে খামার কর্তৃপক্ষকে আশ্বস্ত করার চুক্তিটি একটি ওয়াদা চুক্তি। এটি চূড়ান্ত ক্রয় চুক্তি নয়। [ফিকহুল বুয়ু, পৃষ্ঠা ১১৯]
- বুকিং মানির টাকাটি ‘হামিশ জিদ্দিয়া’ (সিকিউরিটি ডিপোজিট) হিসাবে গণ্য হবে। যা খামারের কর্তৃপক্ষের কাছে আমানাহ হিসাবে থাকবে। খামার কর্তৃপক্ষ এই টাকাটি ব্যবহার করা ব্যতীত সংরক্ষণ করবে। [আল মাআইরুশ শারইয়্যাহ, শরীয়াহ স্টান্ডার্ড নং : (৫) ৬/৮/২]
- পরবর্তীতে ক্রেতা যদি কোন কারণে চুক্তিটি ক্যানসেল করে, তবে বুকিং মানি ক্রেতাকে ফেরত দিতে হবে। এক্ষেত্রে ক্রেতা চুক্তি ক্যানসেল করার কারণে খামার কর্তৃপক্ষের বাস্তবিক কোন ক্ষতি হলে (যেমন, খামার নিজ খরচে পশুটি ক্রেতার বাড়িতে বহন করে নিয়ে গিয়েছে, এরপর ক্রেতা চুক্তি ক্যানসেল করেছে, অথবা ক্রেতা ক্যানসেল করার ফলে পরবর্তীতে বাজার মূল্যের চেয়ে কম মূল্যে বিক্রি করতে হয়েছে) কেবল সে পরিমাণ টাকা বুকিং মানি থেকে কেটে রাখতে পারবে। (প্রাগুক্ত)
আর চুক্তির Point of time হল :
- ডেলিভারির পূর্বে সর্বশেষ ওজন অনুযায়ী মূল্য নির্ধারণের পর। এ সময় নতুন করে অফার এক্সেপ্টেন্সের মাধ্যমে চুক্তি চূড়ান্ত হবে, অথবা hand by hand sele হিসাবে চুক্তি সম্পন্ন হবে।
- আর ক্রেতা যদি খামারেই কুরবানী করে গোশত প্রসেসিং করে নিতে চায়, তাহলে গরু জবাইয়ের পূর্বে সর্বশেষ ওজন অনুযায়ী মূল্য নির্ধারণ করত চুক্তি চূড়ান্ত হবে।
বুকিং দেয়ার পর থেকে চুক্তি চূড়ান্ত হওয়া পর্যন্ত পশুর রিস্ক :
- বুকিং দেয়ার পর বিক্রয় চুক্তি চূড়ান্ত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত পশুর মালিকানা ও রিস্ক খামার কর্তৃপক্ষের থাকবে।
- এ সময়ের মধ্যে পশুটি হারিয়ে গেলে, চুরি হলে, মারা গেলে বা অন্য কোন ক্ষতি হলে খামার কতৃপক্ষই তার দায় নিতে বাধ্য থাকবে।
বুকিং দেয়ার পর থেকে চুক্তি চূড়ান্ত হওয়া পর্যন্ত পশুর যাবতীয় খরচ :
- বুকিং দেয়ার পর বিক্রয় চুক্তি চূড়ান্ত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত যেহেতু পশুর রিস্ক ও মালিকানা খামার কর্তৃপক্ষের, তাই এ সময় পশুর খাবার ও রক্ষণাবেক্ষণের যাবতীয় খরচও খামার কর্তৃপক্ষেরই বহন করতে হবে।
চুক্তি চূড়ান্ত করণ :
- বুকিং দেয়ার পর ক্রেতার সুবিধা অনুযায়ী যে কোন সময় চুক্তি চূড়ান্ত করা যাবে।
- চুক্তি চূড়ান্ত করার জন্য নতুন করে মৌখিক বা আচরণগত অফার এক্সেপ্টেন্স লাগবে।
- চুক্তি যদি বাকিতে বা কিস্তিতে হয়, তাহলে মূল্য পরিশোধের তারিখ সুনির্দিষ্ট হতে হবে।
- চুক্তি চূড়ান্ত করার পর থেকে পশুর মালিকানা ও ঝুঁকি ক্রেতার থাকবে।
- এরপর যদি কিছু সময় পশু খামারে রাখতে হয়, তবে পশুর খাবার ও রক্ষণাবেক্ষণের খরচও ক্রেতাকে বহন করতে হবে। তবে খামার কর্তৃপক্ষ স্বেচ্ছায় উক্ত খরচ বহন করলে কোন সমস্যা নেই।
- এ সময় থেকে খামারের কর্তৃপক্ষের কাছে পশুটি আমানাহ হিসাবে থাকবে। অতএব খামারের কর্তৃপক্ষের ত্রুটি-অবহেলা, সীমালঙ্ঘন ও চুক্তিতে কৃত শর্তের বিপরীত কোন কাজ ব্যতীত পশুটি ক্ষতিগ্রস্থ হলে বা মারা গেলে খামার কতৃপক্ষ ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য থাকবে না।
ডেলিভারি চার্জ :
- এক্ষেত্রে চুক্তির Point of time লক্ষণীয়। অর্থাৎ চুক্তি যদি পশু ক্রেতার ঠিকানায় পৌঁছে দেয়ার পর চূড়ান্ত হয়, তবে ডেলিভারি চার্জ খামার কর্তৃপক্ষকে বহন করতে হবে।
- আর চুক্তি যদি ডেলিভারির পূর্বে হয়, তবে ডেলিভারি চার্জ ক্রেতার উপর বর্তাবে। তবে খামার কর্তৃপক্ষ চাইলে স্বেচ্ছায় উক্ত চার্জ বহন করতে পারবে।
- ভালো হল, ডেলিভারি চার্জ কে বহন করবে তা আগেই আলোচনা করে নেয়া।
পশু নির্দিষ্ট করণ :
- পশু ক্রয়ের ক্ষেত্রে তা এমনভাবে সুনির্দিষ্ট করে নিতে হবে যাতে কোন অস্পষ্টতা না থাকে এবং বিবাদ সৃষ্টি হওয়া সম্ভবনা না থাকে। অনলাইন ও খামার থেকে পশু ক্রয়ের ক্ষেত্রে এই বিষয়টি বিশেষভাবে লক্ষণীয়।
- খামার থেকে পশু ক্রয়ের ক্ষেত্রে সরাসরি খামারে গিয়ে দেখে এবং পশুর বয়স ইত্যাদি জেনে পশু নির্দিষ্ট করা যাবে। এছাড়া অনলাইনেও পশুর ছবি, ভিডিও দেখে, দাত, বয়স, ওজন ও অন্যান্য তথ্য জেনে পশু নির্দিষ্ট করা যাবে। তবে উত্তম হল, সরাসরি দেখেই নির্ধারণ করা। ছবি ও ভিডিওতে সীমাবদ্ধ না থাকা।
- বুকিং মানি প্রদানের সময়ই পশু সুনির্দিষ্ট হওয়া আবশ্যক না। বরং অনির্দিষ্ট পশুর জন্যও বুকিং মানি দেয়া যাবে। তবে চুক্তির Point of time তথা যখন চুক্তি চূড়ান্ত হচ্ছে, সে সময় অবশ্যই পশু সুনির্দিষ্ট হতে হবে।
মূল্য নির্ধারণ পদ্ধতি ও লাইভ ওয়েটে পশু বিক্রয়ের বিধান :
- চুক্তি চূড়ান্ত করার পূর্বে সুনির্দিষ্ট মূল্য নির্ধারণ করা আবশ্যক। মূল্য নির্ধারণের স্বাভাবিক পদ্ধতি হল, ক্রেতা বিক্রেতা দরদাম করে মূল্য নির্ধারণ করা।
- বর্তমানে খামারে ও অনলাইনে পশু বিক্রয়ের ক্ষেত্রে মূল্য নির্ধারণের একটি বিশেষ পদ্ধতি হল, লাইভ ওয়েটে মূল্য নির্ধারণ করা। শরীয়াহ দৃষ্টিকোণ থেকে এতে কোন সমস্যা নেই। এটি মূলত ওজন দিয়ে মূল্য সম্পর্কে ধারণা নেয়া, এরচেয়ে বেশি কিছু নয়। (ফাতাওয়া উসমানী : ৩/৯৯)
- কোন কোন খামারে বুকিং দেয়ার পর থেকে পশুর যাবতীয় খরচ, ডেলিভারি চার্জ, পসেসিং কস্ট ইত্যাদি মূল্যের মাঝে অন্তর্ভুক্ত করে মূল্য নির্ধারণ করা হয়। এটিও বৈধ, শরীয়াহ দৃষ্টিকোণ থেকে এতেও কোন সমস্যা নেই।
অনলাইনে পশু ক্রয়ের পর ত্রুটিযুক্ত পেলে বা বিবরণ অনুযায়ী না পেলে করণীয় :
- অনলাইনে পশু দেখে ও পশুর যাবতীয় তথ্য জেনে ক্রয় করার পর কোন ত্রুটি পেলে কিংবা বিবরণ অনুযায়ী না পেলে ক্রেতার জন্য তা ফেরত দেয়ার সুযোগ থাকবে। সেক্ষেত্রে ফেরত দেয়ার খরচ ক্রেতাকে বহন করতে হবে। তবে যদি বিক্রেতা ইচ্ছাকৃত কোন দোষ গোপন করে থাকে, তাহলে ফেরত দেয়ার খরচ বিক্রেতার উপর বর্তাবে। [ফিকহুল বুয়ু, পৃষ্ঠা ৮৭১-৮৭২]
- এক্ষেত্রে ভালো হল, ক্রটিযুক্ত পেলে বা বিবরণ অনুযায়ী না পেলে ফেরত দেয়ার খরচ কে বহন করবে সেটা চুক্তির সময়ই আলোচনা করে নেয়া।
এক নজরে খামারীদের জন্য নির্দেশনা
- বুকিং মানির প্রদানের সময় ক্রেতাকে বলে দেয়া যে, এটি চুক্তির পূর্ব অংশ। মূল বিক্রয় চুক্তি হবে সর্বশেষ ওজন হিসাবে ডেলিভারির সময়।
- ডেলিভারি চার্জ, প্রসেসিং ফী, পশু ত্রুটিযুক্ত হলে তা ফেরত দেয়ার খরচ ইত্যাদি কে বহন করবে তা শুরুতেই আলোচনা করে নেয়া।
- পেমেন্ট পদ্ধতি, অনলাইনে পেমেন্ট করা হলে অতিরিক্ত চার্জ কে বহন করবে সেটাও স্পষ্ট করে নেয়া।
- কুরবানী শুদ্ধ হওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক যে সকল দোষ আছে, বিক্রয়ের জন্য প্রস্তুতকৃত পশু সে সকল দোষ থেকে মুক্ত সেটাও স্পষ্ট করা। এক্ষেত্রে অনলাইনে পশুর এড দেয়ার সময়ই ডেসক্রিপশনে কোন কোন দোষ কুরবানী শুদ্ধ হওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক এবং বিক্রয়ের জন্য প্রস্তুতকৃত পশু তা থেকে মুক্ত লিখে দেয়া যেতে পারে।
এক নজরে ক্রেতাদের জন্য নির্দেশনা
- নিয়ত শুদ্ধ করা।
- চুক্তির Point of time সম্পর্কে জানা।
- ক্রয়কৃত পশু কুরবানী শুদ্ধ হওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক দোষসমূহ থেকে মুক্ত কিনা যাচাই করে নেয়া।
- ডেলিভারি চার্জ, পসেসিং ফী, পশু ত্রুটিযুক্ত হলে তা ফেরত দেয়ার খরচ কোনটা কে বহন করবে ইত্যাদি বিষয় চুক্তির পূর্বেই বিক্রেতার সাথে আলোচনা করে নেয়া।
প্রস্তুতকারক: গবেষণা বিভাগ, মারকাযু দিরাসাতিল ইকতিসাদিল ইসলামী, বনশ্রী, ঢাকা