Elegant Islamic History Class Google Classroom Header

কিনায়া তালাক

ভূমিকা:

ইসলাম একটি পরিপূর্ণ জীবনব্যবস্থা, যা মানুষের ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক জীবনকে সুন্দরভাবে পরিচালনার পথ দেখায়। বিশেষ করে পারিবারিক জীবনে ইসলাম অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়েছে সুসম্পর্ক, সহনশীলতা এবং পারস্পরিক সহযোগিতাকে। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক যেন টিকে থাকে এবং অকারণে ভেঙে না পড়ে, সে জন্য কুরআন ও সুন্নাহয় বিভিন্ন নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তবুও যদি দাম্পত্য জীবনে এমন সমস্যা সৃষ্টি হয় যা পারস্পরিক সম্পর্কের মধ্যে চরম তিক্ততা এনে দেয়, তাহলে ইসলাম তা সহ্য করতে বাধ্য করে না। বরং সমাধানের পথ দেখিয়ে দেয়।

আল্লাহ তাআলা বলেন:

“আর যদি তোমরা স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিরোধের আশঙ্কা করো, তবে স্বামীর পক্ষ থেকে একজন এবং স্ত্রীর পক্ষ থেকে একজন সালিশ নিযুক্ত করো। তারা যদি মীমাংসা করতে চায়, তাহলে আল্লাহ তাদের উভয়ের মধ্যে মিল করিয়ে দেবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ সব কিছু জানেন এবং সব খবর রাখেন।”

📖 সূরা আন-নিসা (৪:৩৫)

এই আয়াতের আলোকে বুঝা যায়, দাম্পত্য কলহে সরাসরি তালাকের পথে না গিয়ে প্রথমে উভয় পরিবারের পক্ষ থেকে সালিশ কমিটি গঠন করে মীমাংসার চেষ্টা করতে হবে।

তবুও যদি দাম্পত্য সম্পর্কে শান্তি ও সমঝোতার কোনো উপায় না থাকে, তাহলে ইসলাম তালাকের দ্বার খোলা রেখেছে।

তবে এই তালাককে ইসলাম কেবল অনুমতি দিয়ে থেমে যায়নি; বরং একে অত্যন্ত অপছন্দনীয় কাজ বলেও আখ্যায়িত করেছে।

রাসূলুল্লাহ ﷺ ইরশাদ করেছেন:

“আল্লাহর নিকট সবচেয়ে অপছন্দনীয় হালাল বস্তু হলো তালাক।”

📘 সুনান আবু দাউদ, হাদীস: ২১৭৮; হাদীসটি হাসান বলা হয়েছে।

তালাক দেওয়ার ক্ষেত্রে ‘সরাসরি (সরীহ)’ ও ‘ইঙ্গিতে (কিনায়াহ)’ শব্দ ব্যবহারের দুটি রীতি রয়েছে। আমরা প্রায়শই ‘কিনায়াহ’ তালাক শব্দটি শুনে থাকি। কিনায়াহ বলতে কী বোঝায়? কীভাবে তা দ্বারা তালাক কার্যকর হয়? এসব বিষয় সহজভাবে বোঝাতে একটি সারণি আকারে নিচে উপস্থাপন করা হলো, যেন সাধারণ পাঠকও বিষয়টি অনায়াসে উপলব্ধি করতে পারেন।

🔹কিনায়াহ্ অর্থ:
কিনায়াহ্ হলো এমন ইঙ্গিতপূর্ণ কথা, যা স্পষ্টভাবে তালাক নয়, কিন্তু তালাক বোঝানোর অর্থ বহন করে।

🧾 তিনটি পরিস্থিতি (তালাক সংক্রান্ত):

ক্রমিক পরিস্থিতি ও ব্যাখ্যা
সম্পূর্ণ শান্ত অবস্থা (رضا) — স্বামী-স্ত্রী স্বাভাবিক কথাবার্তায় আছে।
রাগ বা উত্তেজনার অবস্থা (غضب)
তালাক সংক্রান্ত আলোচনার পরিস্থিতি (مذاكرة الطلاق)

🧾কিনায়াহ্‌ তালাকের বিধান

বিষয় ব্যাখ্যা
কিনায়াহ্‌ (كناية) যেসব শব্দ তালাকের জন্য নির্ধারিত নয়, তবে তালাকের অর্থ বহন করে।
তালাক কার্যকর হবে কিনা? বিচারিকভাবে (قضاءً) কার্যকর হবে না যতক্ষণ না নিয়ত (তালাক দেওয়ার উদ্দেশ্য যদি ব্যক্তির মনে থাকে) থাকে, অথবা পরিস্থিতিগত প্রমাণ (دلالة الحال) থাকে অর্থাৎ তালাক নিয়ে আলোচনা চলছে, অথবা স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে রাগ ও বিরক্তির পরিপ্রেক্ষিতে বাক্যটি বলা হয়েছে।

📂 কিনায়াহ্ বাক্য তিনটি শ্রেণি বিভক্ত:

শ্রেণি উদাহরণ বৈশিষ্ট্য
প্রত্যাখ্যানযোগ্য অর্থাৎ

যেসব বাক্যে প্রত্যাখ্যান বা ফেরানোর সম্ভাবনা থাকে (رد হতে পারে)

“বের হয়ে যাও”, “চলে যাও”, “উঠে দাঁড়াও”, “ঘর পাল্টাও”, “পালাও”, “অন্যত্র চলে যাও”, “অবিবাহিত থেকো” তালাকের ইঙ্গিত আছে, কিন্তু নিশ্চিত নয়
গালিসূচক বা অপমানমূলক অর্থাৎ যেসব বাক্যে গালি, অপমান বা তিরস্কারের অর্থও থাকতে পারে

 

“তুমি মুক্ত”, “তুমি নিষ্কৃতি পাও”, “তুমি হারাম”, “তুমি বিচ্ছিন্ন”, “তুমি এক”, “তুমি স্বাধীন”, “তোমার ইচ্ছামতো কর”, “আমি তোমাকে ছেড়ে দিলাম”, “আমি তোমার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করলাম” অপমানসূচক, তালাক বোঝায়
নিরপেক্ষ অর্থাৎ যেসব বাক্যে গালি বা প্রত্যাখ্যানের ইঙ্গিত নেই, কিন্তু তালাকের সম্ভাবনা আছে

 

আমার তোমার মধ্যে আর কিছু নেই, আমি তোমার দায়িত্ব শেষ করলাম, আমি তোমাকে ছেড়ে দিলাম,
আমাদের সম্পর্ক এখানেই শেষ, তুমি এখন থেকে স্বাধীন, আমি আর তোমার স্বামী নই, আজ থেকে তুমি আমার স্ত্রী নও, আমি তোমার থেকে আলাদা হয়ে গেলাম, আমি তোমাকে নিজের থেকে আলাদা করলাম
তালাকের সরাসরি ইঙ্গিত বহন করে

⚖️ তালাক কার্যকর হবে কিনা—পরিস্থিতি অনুযায়ী:

পরিস্থিতি প্রত্যাখ্যানযোগ্য তালাকের শব্দ গালিসূচক তালাকের শব্দ নিরপেক্ষ তালাকের শব্দ
শান্তিপূর্ণ (رضا) হবে না (নিয়ত ছাড়া)[1] হবে না (নিয়ত ছাড়া) হবে না (নিয়ত ছাড়া)
রাগের সময় (غضب) নিয়ত থাকলে হবে নিয়ত থাকলে হবে হবে না (নিয়ত ছাড়া)
তালাকের আলোচনা নিয়ত থাকলে হবে নিয়ত ছাড়াও হবে নিয়ত ছাড়াও হবে

🗣️ বিচারকের সামনে কীভাবে প্রমাণ হবে?
– স্বামী বলবে: “আমি নিয়ত করিনি”—তাহলে তাকে শপথ করানো হবে।
– সে যদি শপথ না করে, তবে বিচারক তালাক কার্যকর করে বিচ্ছেদ ঘোষণা করতে পারবেন।

📝 মনে রাখার সহজ সূত্র:
কিনায়াহ্ বাক্যে তালাক হবে কি না, তা নির্ভর করে –
👉 বাক্যটি কোন শ্রেণির
👉 এবং বলা হয়েছে কোন অবস্থায়
👉 এবং নিয়ত ছিল কি না

[1] নিয়ত করেনি এ ব্যাপারে যদি তাকে কসম করতে বলা হয় তাহলে ঘরে থেকেই কসম করলে যথেষ্ট হবে। তবে যদি কসম করতে অস্বিকার করে তাহলে বিচারকের দরবারে উঠানো হবে।

রেফারেন্স
Ibn ʿĀbidīn, Radd al-Muḥtār ʿala al-Durr al-Mukhtār (commonly known as Hāshiyat Ibn ʿĀbidīn), vol. 3, p. 297, Dār al-Kutub al-ʿIlmiyya, Beirut, 1412 AH / 1992 CE.

লেখক:

মুফতী আহসানুল ইসলাম

শিক্ষক: ইসলামী অর্থনীতি

সহকারী পরিচালক: মারকাযু দিরাসাতিল ইকতিসাদিল ইসলামী, Centre for Islamic Economics Studies (CIES)

Share:

Facebook
Twitter
Pinterest
LinkedIn
Scroll to Top