Green and Gold Islamic Modern Ramadan Presentation (1)

ইসলামী অর্থনীতির আলোকে দেশের নাগরিকদের প্রতি রাষ্ট্রের দায়িত্ব ও কর্তব্য

ভূমিকা: 

ইসলামী অর্থনীতির মূল দর্শন হলো মানবকল্যাণ, ন্যায়বিচার ও সামাজিক ভারসাম্য নিশ্চিত করা। এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য রাষ্ট্র একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। একজন মুসলিম রাষ্ট্রপ্রধান কেবল শাসক নন, বরং তিনি একজন দায়িত্বশীল অভিভাবক, যার ওপর সমস্ত নাগরিকদের বিশেষত দরিদ্র, অসহায় ও অক্ষমদের হেফাজতের দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে। ইসলাম এমন এক জীবনব্যবস্থা, যেখানে রাষ্ট্র ও সমাজ পারস্পরিক সহযোগিতা, দায়িত্ববোধ ও ইনসাফের ভিত্তিতে গঠিত। ফলে ইসলামী রাষ্ট্রের কাছে নাগরিকদের শুধু নিরাপত্তা চাওয়া নয়, বরং সম্মানজনক জীবনযাপনের সকল উপকরণ পাওয়ার অধিকার রয়েছে। রাষ্ট্রের ওপর প্রত্যেক নাগরিকের প্রতি দায়িত্ব ঠিক তেমনই বাধ্যতামূলক যেমনটি ব্যক্তির ওপর তার পরিবারের প্রতি দায়িত্ব পালন করা ফরজ। যখন রাষ্ট্র এইসব দায়িত্ব পালন করে, তখন প্রকৃতপক্ষে সে নাগরিকদের কল্যাণ সাধন ও সম্মানজনক জীবনযাপন নিশ্চিত করার কাজ করে।  নিম্নোক্ত দায়িত্বসমূহ পালনের মধ্য দিয়ে একটি রাষ্ট্র এই দায়িত্ব সঠিকভাবে আঞ্জাম দিতে সক্ষম হয়। 

প্রথম: 

বেকারদের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা:

মুসলিম শাসকের দায়িত্ব কর্মহীনদের জন্য উপযুক্ত কাজের ব্যবস্থা করা, তাদের প্রশিক্ষণ ও প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম সরবরাহ করা। এর ফলে ব্যক্তি নিজ দায়িত্বে আত্মনির্ভরশীল হতে পারে এবং রাষ্ট্রের উপর বোঝা না হয়ে কর্মক্ষম নাগরিকে পরিণত হয়।

দ্বিতীয়:  

যাদের ভরণপোষণের কেউ নেই, তাদের ব্যয়ভার বহন করা:

যে সব মানুষের ভরণপোষণের জন্য কেউ নেই, তাদের দায়িত্ব রাষ্ট্রের। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন: “যে কোনো মুমিন মারা গেলে তার সম্পদ তার উত্তরাধিকারীদের, আর কেউ ঋণ বা পরিবার রেখে গেলে তা আমার (রাষ্ট্রপ্রধানের) দায়িত্ব।” (সহীহ মুসলিম, ১৬১৯)

এই হাদীস থেকে বোঝা যায়, অসুস্থ, পাগল, বৃদ্ধ, শিশু—যাদের পক্ষে উপার্জন করা সম্ভব নয় এবং যাদের জন্য কোনো আত্মীয় নেই বা থাকলেও তারা অক্ষম, তাদের দায়িত্ব ইসলামী রাষ্ট্রের। ফুকাহায়েকেরাম এ বিষয়ে একমত যে, এমন কারো ভরণপোষণের দায়িত্ব রাষ্ট্রের অর্থভাণ্ডারের (বায়তুল মাল) ওপর বর্তায়। হানাফি মাজহাব মতে, যদি বায়তুল মাল ব্যয় করতে অস্বীকৃতি জানায়, তবে কাজি (নিয়োগপ্রাপ্ত বিচারক) তাকে তা করতে বাধ্য করতে পারেন।

এমনকি অমুসলিম নাগরিকদের প্রতিও রাষ্ট্র এই দায়িত্ব পালন করবে। যেমন খালিদ ইবনুল ওয়ালিদ (রাযি.) ইরাকের ‘আহল হীরা’ নামক অমুসলিম নাগরিকদের সাথে চুক্তিতে বলেছিলেন:

“যে বৃদ্ধ ব্যক্তি কাজ করতে অক্ষম, বা কোনো দুর্যোগে পতিত হয়েছে, কিংবা ধনী ছিল কিন্তু দরিদ্র হয়েছে এবং এখন তার ধর্মীয় সম্প্রদায় তার ভরণপোষণ করছে—তবে আমি তার উপর থেকে জিজিয়া (কর) রহিত করব এবং তাকে ও তার পরিবারকে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে ভরণপোষণ দেব।” (কিতাবুল খারাজ, পৃ.১৪৪)

তৃতীয়:

বিনামূল্যে শিক্ষা ও চিকিৎসা প্রদান করা:

শিক্ষা ও চিকিৎসা মানুষের মৌলিক অধিকার। ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে এই দুটি খাত জাতির উন্নয়নের মূল ভিত্তি। অজ্ঞতা মানুষকে পেছনে টানে, আর রোগ মানুষকে দুর্বল করে। তাই সব নাগরিকের জন্য মানসম্মত শিক্ষা ও চিকিৎসা সেবা সহজলভ্য করা রাষ্ট্রের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব।

চতুর্থ:  

বৃদ্ধ, অক্ষম, প্রতিবন্ধী ও বার্ধক্যজনিত সমস্যাগ্রস্তদের জন্য আশ্রয়কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা:

এ সমস্ত দায়িত্ব একসাথে পালনের নির্দেশনা রয়েছে রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর হাদীসে: “সাবধান! তোমাদের প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল, এবং প্রত্যেককেই তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। শাসকও দায়িত্বশীল এবং তাকে তার প্রজাদের বিষয়ে জবাবদিহি করতে হবে।” (সহীহ বুখারী, ৮৯৩) 

এই হাদীসের মর্মবাণী থেকেই রাষ্ট্রের দায়িত্ব ও নাগরিকের অধিকার স্পষ্ট হয়। এবং রাষ্ট্র তার কর্তব্য অনুধাবন করে ও নাগরিকদের অধিকার পূরণে সচেষ্ট হয়।

পঞ্চম:  

ক্ষুধার্ত, বিপর্যস্ত ও সংকটাপন্ন মুসলমানদের পাশে দাঁড়ানো এবং তাদের সহায়তা করা:

– যাদের ক্ষুধার্ত হওয়ার আশঙ্কা আছে  

– প্রাকৃতিক দুর্যোগে আক্রান্তরা  

– শত্রুর হুমকিতে থাকা সম্প্রদায়  

– মসজিদ ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নির্মাণে  

কারণ মুসলমানরা পরস্পরের প্রতি একতাবদ্ধ। তাদের মধ্যে ন্যূনতম ব্যক্তিও সকলের নিরাপত্তার দায় নেয়। হাদীসে এসেছে:

“মুসলমান মুসলমানের জন্য একটি ভবনের মতো, একে অন্যকে শক্ত করে ধরে রাখে।” (সহীহ বুখারী, ৪৮১)

আরও এসেছে:

“যদি শরীরের কোনো একটি অঙ্গ ব্যথায় আক্রান্ত হয়, তবে পুরো শরীর জ্বর ও অস্থিরতায় সাড়া দেয়।” (সহীহ বুখারী, ৬০১১)

 

শেষ কথা:
ইসলামী অর্থনীতির আলোকে রাষ্ট্রের দায়িত্ব ও কর্তব্য শুধুমাত্র প্রশাসনিক কার্যক্রম সীমাবদ্ধ নয়; বরং এটি একটি আমানত, একটি ইবাদত। একজন মুসলিম শাসকের দায়িত্ব হলো দেশের প্রতিটি নাগরিকের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করা, বিশেষ করে দরিদ্র, অসহায়, অক্ষম ও বিপর্যস্তদের জন্য। কর্মসংস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা, আশ্রয় ও নিরাপত্তা—এই পাঁচটি খাতে রাষ্ট্রের সক্রিয় দায়িত্ব ইসলাম সুস্পষ্টভাবে নির্ধারণ করেছে। এসব দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করলেই রাষ্ট্র একটি ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গঠনে সক্ষম হবে, যেখানে সব নাগরিক সম্মান, সুবিচার ও মর্যাদাপূর্ণ জীবন লাভ করবে। ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থার এই নীতিগুলোর সফল বাস্তবায়নই জাতির সামগ্রিক কল্যাণ ও দুনিয়া-আখিরাতের মুক্তির পথ।

লেখক: 

মাওলানা আহসানুল ইসলাম, CSAA

ভাইস প্রিন্সিপাল: মারকাযু দিরাসাতিল ইকতিসাদিল ইসলামী

সূত্র:
আত-তুরাইকী, ড. আব্দুল্লাহ বিন আব্দুল মুহসিন। আল-ইকতিসাদুল ইসলামী: উসুল ওয়া মাবাদিয়ু ওয়া আহদাফ। মুআস্সাসাতুল যুরাইসি লিত তাওযীয়ি ওয়াল ই’লান, প্রকাশনা, ১৪৩০ হি. (২০০৯ ঈ.)। পৃ. ১০৫–১০৭।

Share:

Facebook
Twitter
Pinterest
LinkedIn
Scroll to Top